রবিবার, ০৫:০৫ অপরাহ্ন, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

বিএনপি খুশি, আওয়ামী লীগ কি চিন্তিত

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২২
  • ৯৭ বার পঠিত

নানা উপায়ে বাধা দিয়েও শনিবার খুলনায় বিএনপির সমাবেশ বন্ধ করা যায়নি। বরং যানবাহন চলাচল বন্ধ করে কিংবা লাঠিসোটা নিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীরা পথে পথে অবস্থান নিয়ে বাধা দেওয়ার পরও বড় সমাবেশ করতে পেরে বিএনপি খুশি। সরকার ভয় দেখিয়ে বিএনপিকে আর ঘরে বসিয়ে রাখতে পারবে না বলে মনে করছেন দলটির নেতারা। সমাবেশের অনুমতি দিয়ে সমাবেশস্থলে মানুষের উপস্থিত হওয়ার পথে বাধা দিয়ে সরকার উচিত কাজ করেনি বলে মানুষ সরকারের দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করছে।

খুলনার সমাবেশের ভাষণে নেতাকর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আপনারা অসাধ্যকে সাধন করেছেন। তিন দিন ধরে জলে-স্থলে সব পরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দুই দিন ধরে বাস বন্ধ, লঞ্চ বন্ধ, নৌকা বন্ধ, খেয়াঘাট বন্ধ করা হয়েছে। কিছুই চলতে দেওয়া হয়নি। তার পরও কি আপনাদের গণতন্ত্রের যে আকাক্সক্ষা, অধিকার প্রতিষ্ঠার যে লড়াই, সে লড়াইয়ে বাধা দিতে পেরেছে? ইতিহাস বলে, কোনোদিন জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি উপেক্ষা করে শুধু শক্তি দিয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে মানুষকে দমিয়ে রাখা যায় না। সেটিই আপনারা আবার প্রমাণ করেছেন।’

বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, দাবি না মানলে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে। এই স্বৈরাচারী সরকারকে হটাতে বাংলাদেশের মানুষ আজ জেগে উঠেছে। এই গণসমাবেশের যে দাবি, তা মেনে নিয়ে সরকারকে স্বেচ্ছায়, মানে মানে কেটে পড়া উচিত। অন্যথায় এই অবৈধ সরকারকে কীভাবে নামাতে হয়, তা জনগণের আন্দোলনই ঠিক করে দেবে।
বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে মানুষের উপস্থিতি বাড়িয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে নতুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চায় বিএনপি। ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামের গণসমাবেশের মধ্য দিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে ধারাবাহিক কর্মসূচি শুরু করেছে বিএনপি। ১৬ অক্টোবর ময়মনসিংহ এবং ২২ অক্টোবর শনিবার খুলনায় গণসমাবেশ করেছে দলটি। আগামী ২৯ অক্টোবর রংপুরে পরবর্তী গণসমাবেশ হওয়ার কথা। পর্যায়ক্রমে অন্য সাংগঠনিক বিভাগগুলোতেও গণসমাবেশ করে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হবে ধারাবাহিক এ কর্মসূচি। ঢাকায় ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশ থেকে নতুন পর্যায়ের আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ১০ ডিসেম্বর ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে নতুন কী কর্মসূচির ঘোষণা দেবে বিএনপি তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল আছে। সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ও প্রয়োজন অনুযায়ী কর্মসূচি নির্ধারণ করা হবে জানিয়েছেন দলের নেতারা। বিভাগীয় নেতাদের সঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য আলোচনার পাশাপাশি বৃহত্তর আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে সমমনা বিভিন্ন দলের সঙ্গেও আলোচনা চলছে দলটির। সরকার পতনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের জন্য আরও কয়েকটি দল তৈরি হচ্ছে বলেও শোনা যাচ্ছে।

কর্মসূচির ধরন সম্পর্কে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, ১০ ডিসেম্বরের পরের কর্মসূচির বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্তাব এসেছে। কর্মসূচির ধরন নিয়ে এখনো ফোরামে কোনো আলোচনা হয়নি। আলোচনা করেই বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।

তবে আলোচনায় হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও, লংমার্চ, রোডমার্চ, গণমিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচির বিষয়ে প্রস্তাব এসেছে। সময় ও পরিস্থিতি এবং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে কর্মসূচিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে বলে জানা গেছে।

তবে ১০ ডিসেম্বর নিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমানের এক মন্তব্যে এরই মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা উত্তেজনা ছড়িয়েছে। কয়েক দিন আগে আমান বলেছিলেন, ‘১০ ডিসেম্বরের পর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়।’ আমানউল্লাহ আমান বিশেষ কোনো তথ্যের ভিত্তিতে এই হুঙ্কার দিয়েছেন, নাকি একটি চমকপ্রদ কথা বলে আলোচনায় এসেছেন, তা অবশ্য পরিষ্কার নয়।

ডিসেম্বরে নতুন মাত্রার আন্দোলন শুরু করার কথা বললেও বিএনপির নেতারা আপাতত চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন এ মাসেই রংপুরের কর্মসূচিকে। বিভাগীয় পর্যায়ে সমাবেশ সফল করার মধ্য দিয়ে মাঠে সক্ষমতার পরীক্ষা দিচ্ছে বিএনপি। কয়েক বছর ধরে বড় কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে না পারায় বিএনপির মধ্যে যে হতোদ্যম দেখা গিয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে বিভাগীয় সমাবেশগুলো টনিকের কাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিভাগীয় গণসমাবেশ ঘিরে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে, দিনে দিনে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততাও বাড়ছে। সে কারণে ওইসব কর্মসূচি প- করতে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিএনপির নেতারা মনে করছেন, আগামী দিনগুলোতে প্রতিবন্ধকতার মাত্রা হয়তো আরও বাড়বে।

বিএনপি আপাতত শান্তিপূর্ণ সমাবেশের দিকেই মনোযোগ রাখছে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সরকারকে অহেতুক কোনো সুযোগ দিতে চায় না দলটি। রংপুরের গণসমাবেশ সফল করতে পারলে বিএনপি নিজেদের উত্তীর্ণ ভাববে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ অন্য সব বিভাগের তুলনায় রংপুরে বিএনপির অবস্থান যথেষ্ট দুর্বল। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও স্বৈরশাসক হিসেবে নিন্দিত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্মস্থান হিসেবে বরাবরই রংপুরে জাতীয় পার্টির অবস্থান মজবুত। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী এলাকা হওয়ায় ওই অঞ্চলে সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের অবস্থানও শক্ত। রংপুর বিভাগের সংসদীয় আসনগুলোতে নির্বাচনে বিএনপি কোনোবারই তেমন ভালো ফল করতে পারে না। ফলে রংপুরে বিএনপির সমাবেশে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনার মতো জনসমাগম করতে পারা নিয়ে দলের মধ্যেই সংশয় আছে। এ ছাড়া আগের তিন সমাবেশের মতো রংপুরেও একই কায়দায় বাধা দেওয়া হলে পরিস্থিত আরও কঠিন হতে পারে। তবে বিএনপি আশা করছে, রংপুরে আওয়ামী লীগের বাধার মুখে তাদের পড়তে হলেও জাতীয় পার্টির সহযোগিতা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপির দিকে বেশি ঝুঁকে আছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

নানা বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে বিএনপি যে সমাবেশ করতে পারছে এবং সমাবেশগুলোতে যে বড় শোডাউন হচ্ছে, এটা কি আওয়ামী লীগের জন্য কোনো বার্তা দিচ্ছে? আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে কিনা তা নিয়ে অবশ্য এখনই কিছু বলা উচিত নয়। বিএনপিকে মোকাবিলার কৌশল নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে মতভিন্নতা আছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অনেকে মনে করেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এই ডিসেম্বর থেকেই বিএনপির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাওয়া দরকার। প্রয়োজনে বল প্রয়োগ করে হলেও মাঠের দখল ধরে রাখা দরকার। তবে দলের নেতাদের একটি অংশ মনে করছেন, বল প্রয়োগ করলে বরং আওয়ামী লীগেরই ক্ষতি। বিএনপিকে বাধা দিলে তার সুফল শেষ পর্যন্ত বিএনপির ঘরে যাওয়ার সম্ভাবনাই দেখছেন তারা।

নিজেদের পরিকল্পনার ১০টি সমাবেশের মধ্যে শনিবার পর্যন্ত চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও খুলনা অঞ্চলের সমাবেশ শেষ করেছে ১৫ বছর টানা ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। এর মধ্যে চট্টগ্রামে সমাবেশের আগে পথে পথে বাস থামিয়ে এবং ময়মনসিংহে বাস বন্ধ করে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। আর খুলনার সমাবেশে সেই চেষ্টা আরও প্রকট হয়। পরিবহন ধর্মঘট, লঞ্চ ধর্মঘট, এমনকি শনিবার সকাল থেকে নৌ ও ট্রেন চলাচল সীমিত করে ফেলা হয়। বিএনপির অভিযোগ, ক্ষমতাসীনদের নির্দেশেই এভাবে খুলনামুখী জনস্রােতে বাধা দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা একটি জাতীয় দৈনিকের কাছে বলেছেন, পথে পথে প্রতিবন্ধকতার কারণে যে জনদুর্ভোগ তৈরি হয়েছে, তার সুফল শেষ পর্যন্ত বিএনপির ঘরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মানুষ বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না। সরকার পক্ষ বাড়াবাড়ি করায় বিএনপির সমাবেশ ঘিরে মানুষের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে বেশি। দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমেও আলোচিত হয়েছে বিষয়টি। সরকারের অবস্থানকে অগণতান্ত্রিক বলে মনে করা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর দুজন সদস্য মনে করেন, বাস ও লঞ্চ ধর্মঘটে আওয়ামী লীগেরই ক্ষতি হচ্ছে। সাধারণ জনগণের ক্ষতি হচ্ছে। এটা আওয়ামী লীগ কেন করতে যাবে? এটার কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।

আবার আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর অন্য দুই সদস্য বলেছেন, ডিসেম্বর মাস থেকে বিএনপিকে মাঠে নামতে দেওয়া হবে না। তারা মনে করেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ধৈর্য ধরে থাকার সুযোগে আস্ফালন করছে বিএনপি। তাই পরিষ্কার, এদের আর বরদাশত করা হবে না। মাঠে থাকতে দেওয়া যাবে না।’ আবার আওয়ামী লীগের অনেকের মত হলো, বিএনপি সহিংসতার উসকানি দিচ্ছে। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিলে সহিংসতা হবে। এতে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে, যাতে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমরা চাই না দেশে অশান্তি হোক, বিশৃঙ্খলা হোক। সেটা তো ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আমাদেরই ক্ষতি। ডিসেম্বর মাস আসুক। আমরা ক্ষমতায় আছি, আমরা হুট করে মাথা গরম করব? এটা উচিত নয়।’

দেশের মানুষও চায় না দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠুক। মানুষ নিজের জীবন-জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত আছে। আয় ও ব্যয়ের তফাত মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। মানুষ চায় তার আয় বাড়ানোর অবস্থা তৈরি হোক। জিনিসপত্রের দাম তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাক। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে মানুষের জীবনের সমস্যা সমাধান হবে, বিদ্যুৎ সংকট দূর হবে- এমন নিশ্চয়তা না দিয়ে তো বিএনপি নেতারা বরং আওয়ামী লীগকে দেশছাড়া করার হুমকি দিয়ে ভীতি ছড়ানোর কাজ করছে। আওয়ামী লীগও যে একটি বড় রাজনৈতিক দল এবং তাদের সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যাও খুব কম নয়। বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়ার সময় বাস্তবতা মনে না রাখলে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। দুই বড় দলের নীতিনির্ধারকদেরই এটা মনে রাখতে হবে।

বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com