দেশে অক্টোবর মাসের ১৫ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩৪ জন মারা গেছে৷ গত ২৪ ঘন্টায় মারা গেছে ছয়জন৷ আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৬৬ জন৷
গত সেপ্টেম্বর মাসে ৩০ দিনে মারা গেছে ২৪ জন৷ এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু এখন ভয়াবহ আতঙ্কজনক পর্যায়ে আছে৷
বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে৷ যা ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার প্রজননের জন্য সহায়ক৷ আর চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তরা শক সিন্ড্রোমে মারা যাচ্ছেন বেশি৷ কারণ তারা দেরিতে হাসপাতালে যাচ্ছেন৷ মেডিক্যালের পরিভাষায়, শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণকে শক সিন্ড্রোম বলা হয়৷
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ২৪ হাজার ৩২৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন৷ আর এখন সারাদেশে হাসাপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগী আছেন দুই হাজার ৮৮৯ জন৷
জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৮৯ জন৷ এরমধ্যে জুন মাসে দুজন, জুলাই মাসে নয়জন, আগস্ট মাসে ১১ জন এবং সেপ্টেম্বর মাসে ২৪ জন৷ অক্টোবর মাসের ১৫ দিনে ৩৪ জন৷
ঢাকায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরে জানুয়ারি থেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী অল্প-বিস্তর পাওয়া যাচ্ছিল৷ তবে মে মাস থেকে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে৷ তখন থেকেই আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে৷
মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হন একশ ৬৩ জন, জুন মাসে সাতশ ৩৭ জন, জুলাই মাসে এক হাজার পাঁচ ৭১ জন, আগস্টে তিন হাজার ৫২১ জন, সেপ্টেম্বরে নয় হাজার ৯১১ জন৷ চলতি অক্টোবর মাসের ১৫ দিনে আট হাজার ২৩৪ জন৷
ঢাকার বাসিন্দারাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি৷ ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে এখন ঢাকা মেডিক্যাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, মুগদা হাসপাতাল, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, সোহারাওয়ার্দী হাসপাতাল ও শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেশি৷
জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে মোট ভর্তি হয়েছেন ১৭ হাজার ৯২৪জন আর ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ছয় হাজার ৪০২ জন৷
কারা আক্রান্ত হচ্ছেন, কারা মারা যাচ্ছেন
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ২০ বছরের বেশি বয়সিরাই ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন৷ তাদের মধ্যে মৃত্যুর হারও বেশি৷ মৃতের ৬৪ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিন দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছেন৷ অন্যদিকে ডেঙ্গুতে মৃতদের মধ্যে নারীর সংখ্যা পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি৷ শিশুদের মধ্যেও মৃত্যু হারও বেশি৷
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলছে, ডেঙ্গুর চারটি ভ্যারিয়েন্ট আছে৷ এগুলো হচ্ছে ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪৷ এই চারটি ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে এ বছর তিনটি সক্রিয়৷ এবছর ডেন-৪ ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপ বেশি৷ আবার ডেন-৩ ও ডেন-১ ভ্যারিয়েন্টে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে৷ ২০১৮ সালের পর ডেন-১ ভ্যারিয়েন্টে মানুষের আক্রান্ত হতে দেখা যায়নি৷ ২০২১ সালে আক্রান্ত হয়েছিল ডেন-৩ ভ্যারিয়েন্টে৷ এবার তিনটি ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হওয়ার কারণে প্রকোপ বেশি৷
যারা মারা যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই শক সিন্ড্রোমে মারা যাচ্ছেন বলে জানান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম আব্দুল্লাহ৷ তিনি বলেন, ‘দেরিতে হাসপাতালে যাওয়া বা সঠিক সময়ে না যাওয়ার কারণেই শক সিন্ড্রোম হচ্ছে৷ হাসপাতালে যাওয়ার আগেই রোগীদের শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে৷ ফলে হাসপাতালে যখন নেয়া হয় তখন তাদের বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে৷ দুই-তিন দিনের মধ্যেই তারা মারা যান৷’
তার কথা, ‘এরজন্য সচেতনতার বিকল্প নেই৷ তাই জ্বর বা সর্দি-কাশি হলেই পরীক্ষা করাতে হবে৷ প্রচুর তরল খাবার খেতে হবে৷ দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে৷ যথা সময়ে চিকিৎসকের কাছে গেলে ভয়ের কোনো কারণ নেই৷’
তিনি জানান, ‘এবার ডেন-৩ এবং ডেন-৪-এ আক্রান্ত হচ্ছে বেশি৷ এটা সিরিয়াস বেশি৷ এটা শরীরে বেশি জটিলতা সৃষ্টি করে৷ আবার আগে যাদের ডেঙ্গু হয়েছে তারাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে৷ তাদেরও জটিলতা বেশি হচ্ছে৷ আর ঠিক সময়ে চিকিৎসকের কাছে না যাওয়ায় পরিস্থিতি আরো জটিল হচ্ছে৷’
এডিশ মশা চার গুণ বেশি
এবার বছরের শুরুতেই ঢাকায় ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার ঘনত্ব বেশি ছিল৷ আর এখন থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় এডিস মশা আরো বাড়ছে বলে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং কীটতত্ববিদ কবিরুল বাশার৷
তিনি বলেন, ‘এবার যে এডিস মশা বেশি হবে তা আমরা আগেই বলেছিলাম৷ তবে অক্টোবর মাসে এরকম আগে হয়নি৷ জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে এবার থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে৷ স্বচ্ছ পানি জমছে যেখানে ডেঙ্গুর প্রজনন হয়৷ টানা বৃষ্টি হলে এরকম হতো না৷ তাই এবার জ্যামিতিক হারে ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ৷’
ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে মশার ঘনত্ব নিয়ে যে প্রাক-মৌসুম জরিপ করে তা থেকে এই সময়ে এডিস মশার ঘনত্ব চার গুণ বেড়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়৷
অধ্যাপক ডা. এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এডিস মশা রাতে নয়, দিনে কামড়ায়৷ তাই দিনের বেলা সতর্ক থাকতে হবে বেশি৷ দিনে ঘুমালে মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে৷ বিশেষ করে শিশুদের ব্যাপারে বাসায় ও স্কুলে সতর্ক থাকতে হবে৷ তাদের শরীর ঢেকে পোশাক পরাতে হবে৷’
অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমরা একটা জরিপ করে দেখেছি যে, এদেশের মানুষ এডিস মশা কীভাবে হয়, প্রজননস্থল, বদ্ধ, স্বচ্ছ পানি-এই সবকিছুই জানে৷ তারপরও তারা সচেতন হন না৷ এটা একটা মানসিকতা৷ এর পরিবর্তন দরকার৷ আর সিটি কর্পোরেশন যতই বলুক তারা আসলে মশার উৎস ধ্বংস করছে না৷ উড়ন্ত এডিশ মশা থেকে যাচ্ছে৷’
সূত্র : ডয়চে ভেলে