রাজনৈতিকভাবে ২০২৩ সাল বিবেচিত হচ্ছে নির্বাচনী বছর হিসেবে। ধারণা করা হচ্ছে, তিন মাস পরে শুরু হতে যাওয়া এই বছরটির বাঁকে বাঁকে ধূমায়িত হতে পারে রাজনৈতিক টানাপড়েনের ঘনঘটা। রাজনীতির মাঠে কর্মসূচিমুখর বিএনপি ইতোমধ্যে নো রিটার্নের পথে পা বাড়িয়েছে। আসছে ডিসেম্বরের পরে দলটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি বাস্তবায়নে ‘ফাইনাল রাউন্ডের খেলায়’ নামার পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে। চলতি বছরের বাকি সময়ে বিভাগীয় পর্যায়ে গণসমাবেশের যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি, তা ফাইনাল রাউন্ডে নামার ‘রিহার্সেল’ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন দলটির কর্মসূচি প্রণয়নের সাথে জড়িত নেতারা।
এ দিকে আন্দোলন কর্মসূচির পাশাপাশি ক্ষমতায় গেলে শাসনব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তনও আনতে চায় বিএনপি। সেই লক্ষ্যে ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ বেশ কিছু মূলনীতি নিয়েও দলটি কাজ শুরু করেছে। সারা দেশে পেশাজীবী পর্যায়ে এসব মূলনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক ব্র্যান্ডিং চলছে, তাদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে পরামর্শও। সাবেক এমপি জহির উদ্দিন স্বপন নেতৃত্বাধীন দলটির মিডিয়া সেল মূলত সেই দায়িত্ব পালন করছে।
বিএনপির রাষ্ট্্র সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে- নির্বাচনোত্তর জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার বা জাতীয় সরকার গঠন, নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠন, সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন, ইসি নিয়োগের আইন সংশোধন, বিচারব্যবস্থা সংস্কারে জুডিশিয়াল কমিশন গঠন, প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠন, ন্যায়পাল নিয়োগ, অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন, রংধনু (রেইনবো ন্যাশন) জাতি প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রসঙ্গে বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়া আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে না। সরকার যদি এই দাবি মেনে না নেয়, তাহলে জনগণের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই তাদের পতন ঘটানো হবে। বিএনপি সেই লক্ষ্যেই সব বাধা পেরিয়ে সামনে এগোচ্ছে।
জনসম্পৃক্ত নানা ইস্যু ও দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যার প্রতিবাদে বিএনপি গত তিন মাস ধরেই টানা কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে। গত ৩১ জুলাই ভোলায় বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে হঠাৎ করেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে বাঁক নেয়। সেখানে পুলিশের গুলিতে যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের দু’জন নেতা নিহত হন। ভোলার ঘটনার পর গত ২২ আগস্ট থেকে ইউনিয়ন-পৌরসভা-উপজেলায় তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও দুই নেতার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে টানা বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করে দলটি। তৃণমূলে বিএনপির এই কর্মসূচি প্রায় অর্ধশত জেলায় হামলার মুখে পড়ে। গত দুই মাসে দলটির ছয় নেতা প্রাণ হারিয়েছেন। তৃণমূলে এই কর্মসূচি শেষ হতে না হতেই ঢাকা মহানগরে বিএনপি জোনভিত্তিক কর্মসূচি ঘোষণা করে। এই কর্মসূচি পালন করতে গিয়েও দলটি কমপক্ষে চারটি স্পটে বাধার মুখে পড়ে। তবে তারা বাধা উপেক্ষা করেই কর্মসূচি অব্যাহত রাখে।
গত বুধবার বিএনপি আরো বড় কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, যা চলবে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত। কর্মসূচির মধ্যে ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামে গণসমাবেশ হবে। এরপর ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহে, ২২ অক্টোবর খুলনায়, ২৯ অক্টোবর রংপুরে, ৫ নভেম্বর বরিশালে, ১২ নভেম্বর ফরিদপুরে, ১৯ নভেম্বর সিলেটে, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লায়, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে এবং সবশেষে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ হবে। এ ছাড়া ভোলা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে নিহত নেতাকর্মীদের স্মরণে ৬ অক্টোবর সব মহানগরে এবং ১০ অক্টোবর সব জেলায় শোকর্যালি করবে দলটি।
জানা গেছে, এসব কর্মসূচি সফলে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে বিএনপি। কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে ইতোমধ্যে গঠন করা হয়েছে ১০টি শক্তিশালী টিম। সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী কমিটির সদস্য, সাবেক এমপি, সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকসহ জেলা নেতাদের রাখা হয়েছে এসব কমিটিতে। প্রতিটি বিভাগের গণসমাবেশ মহাসমাবেশে রূপ দিতে নির্দেশনা দিয়েছে দলটির হাইকমান্ড।
প্রস্তুতি পর্বের প্রতিটি মিটিংয়ে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেবেন স্বয়ং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
দলটির নীতিনির্ধারকরা জানান, চূড়ান্ত আন্দোলনের রিহার্সেল হিসেবে এসব সমাবেশে দলের সাংগঠনিক শক্তি জানান দেয়া হবে। পাশাপাশি সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করাই এ কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য।
বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম বলেন, ঢাকার সমাবেশটি হবে টার্নিং পয়েন্ট। ওই সমাবেশের পরে বিএনপি আন্দোলনের শেষ পর্বে পা রাখবে। সেখান থেকে ঘোষণা করা হবে চূড়ান্ত কর্মসূচি। জানা গেছে, বিএনপি চূড়ান্ত কর্মসূচি হিসেবে রাজপথে টানা অবস্থান কর্মসূচিকে শেষ পর্যন্ত বেছে নিতে পারে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, সরকারি দল এবং পুলিশের বাধা সত্ত্বেও গত দুই মাসে ঢাকাসহ সারা দেশের কর্মসূচি অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
নেতাকর্মীরা যে পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ, সেটি এসব কর্মসূচিতে প্রমাণিত হয়েছে। একইসাথে দলটির আন্দোলন কর্মসূচি পালনে একজন নেতা বা কর্মীও যে বসে থাকতে রাজি নয়, সেটিও পরিলক্ষিত হয়েছে।
তারা মনে করছেন, এসব কর্মসূচিতে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততাও বড়েছে। এই ধারা বজায় থাকলে সামনে আন্দোলন আরো গতি পাবে।