বৃহস্পতিবার, ০৬:৪৯ পূর্বাহ্ন, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫, ২রা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

সিগারেট নেশা, স্মার্টনেস নয়

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২
  • ১৪১ বার পঠিত

প্রায়ই সংবাদপত্রের মারফতে জানা যায়, নেশাগ্রস্ত যুবকের গুলিতে মা-মেয়ে খুন। মাতাল স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন। মাদকাসক্ত মেয়ের হাতে বাবা-মা খুন। জাতীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ভয়াল বিষয় এই মাদক। শিশু থেকে বয়স্ক পর্যন্ত অনেকেই মাদকের ছোবলে বিপন্ন। মাদক লাগামহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জঘন্য পাপাচার। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে চরম অপরাধ। মাদকের জাল যেভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে বাড়ছে উৎকণ্ঠা। সৃষ্টি হচ্ছে হতাশাজনক পরিস্থিতি।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, দেশে মাদকাসক্তের ৮০ ভাগের বয়স ১৮-৩০ বছর। এ ভয়ঙ্কর ব্যাধিতে আক্রান্তের বেশির ভাগ দেশের স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মাদকাসক্তিতে রূপান্তরের প্রধান সোপান সিগারেট। এর বেশির ভাগ-ই শুরু হয় বন্ধু-বান্ধবের সাহচর্যে। শখের বশে আজকাল স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা সিগারেট হাতে তুলে নেয়। অনেকে সিগারেট হাতে নেয় স্মার্টনেস দেখানোর জন্য। সিগারেট থেকে ক্রমে যুবসমাজ গাঁজা, মদ, ফেনসিডিল ও ইয়াবার মতো ভয়ঙ্কর মাদকে জড়িয়ে যায়। তাদের এই অভ্যাস থেকেই আসক্তি জন্মে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭০-৮০ ভাগের ক্ষেত্রে ধূমপান থেকেই মাদক নেয়া শুরু হয়।

বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। কোনো সংস্থার মতে, তা ৭০ লাখের ওপর। তা নব্বইয়ের দশকে রেকর্ড করা হয়েছিল ১০ লাখেরও কম। বর্তমানে এর ৮০ শতাংশই যুবক। তার মধ্যে ৪৩ শতাংশ বেকার। ৫০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধের কাজে লিপ্ত। বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদকাসক্তের ৮৪ ভাগ পুরুষ এবং ১৬ ভাগ নারী। মনোবিদরা মনে করেন, শিক্ষা, চাকরি, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, মানসিক চাপ, বিষণ্ণতা সর্বোপরি আধুনিক জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে নানা সমস্যার কারণেই যুবসমাজ মাদকের দিকে ঝুঁকছে।

করোনাভাইরাসের কারণে লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক গ্র্যাজুয়েট চাকরি প্রত্যাখ্যাত হয়ে হতাশায় ভুগছেন যার দরুন তারা হতাশাকে ভুলতে অনেকেই মাদকে জড়িয়ে যাচ্ছেন। পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, লকডাউনে তরুণদের মাদকাসক্তের হার দ্বিগুণ হয়েছে। তাছাড়া মাদক কেনার অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে শিশু-কিশোররা চুরি ও ছিনতাইয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যা পরিবার, সমাজ সর্বোপরি একটি রাষ্ট্রের সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশ বৈরী করে তুলছে।

মাদকাসক্তির কারণে অনেকের দাম্পত্য জীবনে কলহ ও বিদ্বেষ লেগেই আছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সমাজের নানা অপরাধ যেমন- যৌন হয়রানি, চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ কিংবা সড়ক দুর্ঘটনাতেও বিরাট ভূমিকা পালন করে এই মাদক। একবার এই ভয়াল আসক্তিতে জড়িয়ে পড়লে সহজে বের হওয়ার রাস্তা খোলা নেই।

জাতীয় গবেষণা ইনস্টিটিউটের জরিপে বলা হয়, ০.৮ ভাগ শিশু-কিশোর মাদকাসক্তিতে ভোগে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার জরিপে উঠে এসেছে- প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ৮২ লাখের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে শুধু ধূমপানের কারণে। এ ছাড়াও এখনকার মাদকের প্রায় ৮৫ শতাংশে ভেজাল মিশানো হচ্ছে যার ফলে খুব দ্রুত সেবনকারীকে কিডনি, লিভার ও মস্তিষ্কের জটিল রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে। মাদক নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিও ঘোষণা করেছে। কিন্তু তবুও লাগামহীন মাদকের এ ভয়ঙ্কর থাবা। এ ক্ষেত্রে অনেক কারণ থাকলেও জোরালো কারণ হলো আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করা। মূল হোতাদের আইনের আওতায় না এনে সাধারণ অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তাছাড়া এক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ করতে গেলেই ‘উপর মহল’ থেকে বিভিন্ন চাপ ও বাধার সম্মুখীন হতে হয় আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। এ ব্যাপারে সরকারকে আরো জোরালো এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

মাদকমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে প্রয়োজনীয় যেসব পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে- ১. মাদকাসক্তি প্রতিরোধে সর্বাধিক কার্যকর উপায়, সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা। ২. মাদক প্রস্তুত ও সরবরাহ বন্ধ করা উচিত। বেশি বেশি ধর্মীয় চেতনার লালন করতে হবে। ৩. মাদকের সিন্ডিকেট যত শক্তিশালী-ই হোক না কেন, তা ভাঙতে হবে। সিন্ডিকেটভুক্ত এলাকা চিহ্নিত করে মাদকের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। ৪. মাদকের সাথে জড়িতদের অতিদ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা সময়ের দাবি। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোর হতে হবে। ৫. মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব ও সচেতনতা সম্পর্কে মাধ্যমিক স্তরের প্রতিটি ক্লাসের পাঠ্যবিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ৬. ধর্মীয় নেতা এবং জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে সভাসেমিনারে মাদক নির্মূলে কাজ করতে হবে। সর্বোপরি, অভিভাবকগণ এ বিষয়ে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করতে পারেন। সরকারের একার পক্ষে এটি নির্মূল করা সম্ভব নয়। দরকার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com