শীত পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। এক সপ্তাহ ধরে দেশে মৃদ্যু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছিল। রোববার কোনো কোনো অঞ্চলে তা মাঝারি শৈত্যপ্রবাহে রূপ নেয়। পাশাপাশি এ দিন চলতি মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও রেকর্ড করা হয়। খুলনা বিভাগের যশোর এবং চুয়াডাঙ্গায় ছিল এই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা, যা ব্যারোমিটারে মাপা হয় ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যদিও কয়েক দিন পর রোববার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সূর্য তুলনামূলক বেশি সময়ের জন্য কিরণ দিয়েছে। আকাশে মেঘ কেটে যাওয়ায় আলোর প্রখরতাও ছিল বেশি। এতে দিনের আলোর উষ্ণতা উপভোগ করতে পেরেছে মানুষ। রোদের কারণে দুপুরের দিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে কুয়াশা কেটে যায়। বিশেষ করে শহরাঞ্চল এই সুবিধা পায় বেশি। কিন্তু সূর্যের আলোর তেজ কমতেই কুয়াশার আস্তর পড়তে শুরু করে, যা পরে ধীরে ধীরে হালকা মাঝারি ধরনের ছিল। আর সন্ধ্যার পর এর ঘনত্ব আরও বাড়তে থাকে। ফলে দৃষ্টিসীমা কমে আসতে থাকে। কুয়াশার কারণে বিমান, নৌ ও সড়ক যোগাযোগ বিঘ্নিত হচ্ছে। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে শনিবার রাত ১০টা থেকে রোববার সকার ৮টা পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। শীতের কারণে শীতজনিত রোগবালাই বেড়েই চলেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোববারের হিসাব অনুযায়ীই ৩১৫৬ কোল্ড ডায়রিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি বলে জানা গেছে। আর শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ৪ জন। তাদের মধ্যে ২ জন ময়মনসিংহ, ১ জন খাগড়াছড়ি ও ১ জন ভোলার। তাদের সবাই শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত ছিল।
শৈত্যপ্রবাহের ব্যাপ্তি রোববার আরও বেড়ে যায়। আগের দিন ১১টি জেলায় ছিল মৃদ্যু শৈত্যপ্রবাহ। কিন্তু রোববার উত্তরাঞ্চলের দুই বিভাগ রংপুর ও রাজশাহী বা এই দুই বিভাগের ১৬ জেলা চলছিল শৈত্যপ্রবাহ। পাশাপাশি দেশের মধ্যাঞ্চলের জেলা টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর, সাতক্ষীরা এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ায় মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, সোমবার (আজ) থেকে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ করতে পারে। একটা পর্যায়ে হয়তো শৈত্যপ্রবাহ চলে যাবে, কিন্তু মৌসুমের স্বাভাবিক শীত যাবে না। এরপর আবার মাঘের শুরুতে ফের শৈত্যপ্রবাহ দেখা দিতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) জানায়, দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে যে লঘুচাপ অবস্থান করছিল, সেটি এখন সক্রিয় আছে। শুধু তাই নয়, এর বর্ধিতাংশ রোববার উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। উপমহাদেশের উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় অবস্থান করছে। ফলে এর ফলে আকাশ অস্থায়ীভাবে মেঘলা থাকতে পারে। তবে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। আর সূর্যের আলোর কারণে দিনের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেলেও রাতে যে তাপমাত্রা আছে তা অপরিবর্তিত থাকতে পারে। অর্থাৎ আগামী ৭২ ঘণ্টা রাতের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত এমনকি সামান্য হ্রাস পেতে পারে। তাই রাতে বাড়তি শীতল অনুভূতি থাকছেই।
সাধারণত তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির নিচে নামলে এবং ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলে। এছাড়া তাপমাত্রা ৮ থেকে ৬ ডিগ্রির মধ্যে থাকলে তা মাঝারি আকারের এবং ৬-এর নিচে কিন্তু ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত নামলে তা তীব্র শৈত্যপ্রবাহে পরিণত হয়। আর ৪ ডিগ্রির নিচে নামলে তা অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহে রূপ নেয়।
রোববারে বিএমডির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যশোর এবং চুয়াডাঙ্গায় মাঝারি পর্যায়ের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া অন্যত্র মৃদ্যু শৈত্যপ্রবাহ চলছে। এ দিন ঢাকায় তাপমাত্রা শনিবারের তুলনায় বেশি ছিল। শনিবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু রোববার বেড়ে তা দাঁড়ায় ১২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর এদিন ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শনিবার এটা ছিল ১৫.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ সূর্য ওঠার কারণে প্রায় ৬ ডিগ্রি বেড়েছে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, যা আগের ছিল মাত্র ৩ ডিগ্রি। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১২.৩ ডিগ্রি শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু ঢাকার মানুষ তীব্র শীত অনুভব করেছে। এর কারণ হচ্ছে, সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য ১০ ডিগ্রির নিচে যত কমবে তত শীতের অনুভূতি বাড়বে। অন্যদিকে রোববার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল টেকনাফে ২৮ ডিগ্রি।
বর্তমানে অধিকাংশ এলাকায় শৈত্যপ্রবাহ না থাকা সত্ত্বেও শীত অনুভবের প্রধান কারণই হচ্ছে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন বা দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য ১০ ডিগ্রির নিচে নেমে আসা। এ ছাড়া বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপক এলাকা সূর্যের আলোয় উত্তপ্ত হতে না পারা; সূর্যের স্বল্পমেয়াদি কিরণকাল; দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের প্রভাব; বাতাসের মিশ্রিত হিমালয় পর্বতমালার দিক থেকে আসা শীতল আর্দ্রতা, জেড স্ট্রিম বা ঊর্ধ্বাকাশের বায়ু নেমে আসা ইত্যাদি। এসব কারণ মিলিয়ে ব্যারোমিটারের পারদ শৈত্যপ্রবাহের পর্যায়ে নেমে না আসা সত্ত্বেও শীতের অনুভূতি অনেক বেশি, যা মাঝারি থেকে তীব্র শীতের অনুভূতি তৈরি করছে।
রাজশাহী : ভোরে জেলায় বছরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন শনিবার ভোরে ছিল ৯ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতের দাপট বেড়ে যাওয়ায় ফুটপাতে গরম কাপড়ের দোকানে নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে। পথের ধারে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে অনেকে।
চিতলমারী (বাগেরহাট) : শীতজনিত সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়াসহ নানা রোগ দেখা দিয়েছে। বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন বয়স্ক ও শিশুরা। অতিরিক্ত রোগীর চাপে চিতলমারীর একমাত্র সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বড়বাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়ির শিক্ষক মাহফুজুর রহমান বলেন, কয়েকদিন ধরে এমন শীত পড়েছে, ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না।
হাজীগঞ্জ (চাঁদপুর) : শীতের কারণে দিনমজুর মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। রাস্তার পাশে পেয়ারা বিক্রি করেন আবুল বাসার। তিনি বলেন, তিন দিন ধরে সূর্য দেখি না। স্কুলে শিক্ষার্থীদের কাছে পেয়ারা বিক্রি করতাম। কিন্তু এখন স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম, বেচাবিক্রিও তেমন নেই।
রাজবাড়ী : দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক আলীম দাইয়ান যুগান্তরকে বলেন, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ঘন কুয়াশার কারণে দুর্ঘটনা এড়াতে শনিবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কুয়াশা কেটে গেলে রোববার সকাল ৮টায় ফের চলাচল শুরু হয়।
শেরপুর : সীমান্তবর্তী এ জেলায় ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। কোথাও কোথাও রাতে ও ভোরে বৃষ্টির মতো শিশির ঝরে। হিম বাতাসে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন শিশু, বৃদ্ধ আর ছিন্নমূল মানুষ। গ্রামাঞ্চলে প্রায় দিনই থাকছে কুয়াশার দাপট। মাঠে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে কৃষকের।
ভোলা : ভোলায় দুই দিন পর রোববার দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য সূর্যের দেখা মেলে। এ সময় সূর্যের তাপ নিতে অনেকেই ঘর থেকে বাইরে বের হন। শীতে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন বেড়িবাঁধের ও চরাঞ্চলের মানুষ। ঘন কুয়াশার কারণে ভোলা-লক্ষ্মীপুর ও ভোলা-বরিশাল রুটে ফেরি চলাচল ও ভোলা-ঢাকা রুটে লঞ্চের চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
গোলাপগঞ্জ (সিলেট) : শীতার্ত লোকজনকে সরকারিভাবে যে কম্বল দেওয়া হয়েছে তা চাহিদার তুলনায় খুবই নগণ্য। বুধবারীবাজার ইউপি চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আমার ইউনিয়নে মাত্র ৩শ কম্বল দেওয়া হয়েছে। অথচ একটি ওয়ার্ডেই ৫শ থেকে ১ হাজার কম্বল প্রয়েজন।
চরফ্যাশন (ভোলা) : উপজেলার ছোট-বড় ২০টি চরের মধ্যে শিকদারেরচর, জাহানপুর, চরহাছিনা, চরমোতাহার, চরলিয়লিন, চরমনোহর, চরমাদ্রাজ, চরআশ্রাফ আলম, ঢালচর, পাতিলা, চরফারুকি, চরহাছিনা, চরবদনা, মেঘবাসান, চর আফজাল, চরনাজিম উদ্দিন, চরকলাতলী, সোনার চরাঞ্চলের মানুষ এখন শীতে কাঁপছে। এসব চরের মানুষগুলো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। তাদের প্রধান পেশা নদীতে মাছ ধরা, কৃষিকাজ ও দিনমজুর হিসাবে কাজ করা। তীব্র শীতে এখন ঘর থেকেই বের হওয়া দায়। এওয়াজপুর ইউনিয়নের পানিরকল গ্রামের বৃদ্ধ মোসারেফ ফরাজি বলেন, ‘ঠান্ডাত সারা রাইত নিন (ঘুম) আইয়ে না।’ একই গ্রামের আব্দুল লতিফ, জাহেদা বেগম ও মায়া বেগম বলেন, দুই দিন না খ্যায়া থাকা যায়, কিন্তুক এতো ঠান্ডা সওয়া যায় না।’
কুড়িগ্রাম : রোববার সকাল ৯টায় জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা এ মৌসুমে জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। তাপমাত্রা কমে যাওয়ার ফলে হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা। বিশেষ করে জেলার ২৭৬টি দ্বীপচরের প্রায় সাড়ে ৪ শতাধিক গ্রামের ৫ লক্ষাধিক দরিদ্র মানুষ শীতবস্ত্রের অভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।