জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে পুলিশের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরেও ছাত্রলীগ, যুবলীগের ক্যাডাররা হামলায় অংশ নিয়েছিল। যার সূত্রপাত হয়েছিল গত বছর ১৫ জুলাই ঢাকা থেকে। পুলিশের বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরে যারা ছাত্র-জনতার ওপর হামলায় অংশ নিয়েছিল তাদের তালিকা করছে পুলিশ সদর দপ্তর। তাদের ধরতে পুলিশের অভিযানও চলছে। পাশাপাশি চলছে ফুটেজ বিশ্লেষণ। ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর বিপুল পরিমাণ ফুটেজ পেয়েছে নানা সূত্র থেকে। সেইসব ফুটেজই সাক্ষ্য দিচ্ছে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে কীভাবে নির্বিচারে গুলি করা হয়েছে।
পুলিশের অস্ত্র, গুলিসহ রায়ট সামগ্রী পুলিশ ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি ব্যবহার করেছে কিনা তা অনুসন্ধানের জন্য পুলিশ সদর দপ্তরের লজিস্টিকস অ্যান্ড অ্যাসেট অ্যাকুইজিশন বিভাগের অতিরিক্ত আইজি মো. মোসলেহ উদ্দিন আহমদকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে।
পুলিশ সূত্র বলেছে, কোটা সংস্কারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিকালে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী ক্যাডাররা বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে। ঢাকায় এই হামলা শুরু হয় গত বছর ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে। পরে ঢাকার বাইরে যখন ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হয়, সেখানেও ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী ক্যাডাররা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে। তারা হকিস্টিক, রামদা, লোহার রড দিয়ে হামলার পাশাপাশি আন্দোলকারীদের ওপর গুলিও চালায়। পরবর্তীকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকার পতনের এক দফায় গিয়ে ঠেকলে ছাত্রদের আন্দোলন গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। তখন পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী ক্যাডাররা আরও বেপরোয়া হয়ে
ওঠে। পুলিশের পাশাপাশি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের দমন করতে তারাও নির্বিচারে গুলি চালায়। এ সময় কোনো কোনো এলাকায় পুলিশের বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় বলে পুলিশ সদর দপ্তর বিভিন্ন ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তথ্য পাচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তর অনুসন্ধান করে দেখেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীর উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, চাঁনখারপুল, মিরপুর, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা ও রামপুরায় সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয়। এসব স্থানে পুলিশের পাশাপাশি সিভিলিয়ান লোকজনও পুলিশের বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। এতে একের পর এক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর আমাদের সময়কে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব অস্ত্রধারী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়েছে, ডিজিটাল এভিডেন্স বিশ্লেষণ করে তাদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। তাদের গ্রেপ্তারসহ যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণও অব্যাহত রয়েছে।
পুলিশ সূত্র বলেছে, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরে যারা ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করেছে এ রকম অন্তত ৬৫ জনকে ইতোমধ্যে শনাক্ত করেছে পুলিশ। তাদের ধরতে অভিযান চলছে। শনাক্তদের মধ্যে অন্তত ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-পুলিশ।
সাভারের আশুলিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা ও গুলি করে হত্যার ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছাত্রলীগের ঢাকা জেলা উত্তরের উপ-শিক্ষা ও পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদক ও আশুলিয়া থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু আহম্মেদ। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ইতোমধ্যে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে।
মুন্সীগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হেলমেট পরে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করেন শহর ছাত্রলীগ সভাপতি নসিবুল ইসলাম নোবেল ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাত হোসেন সাগর। তার দুটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। একটি ৪ আগস্টের ও অপরটি ১৯ জুলাইয়ের। ভিডিওতে দেখা গেছে, গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাচ্ছেন ছাত্রলীগের এই দুই নেতা। তারা নিজেদের পরিচয় আড়াল করতে হেলমেট ও গামছা পরে গুলি করেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর দুজনই পালিয়ে যান।
জানা গেছে, গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় শহীদুল্লাহ হলের সামনে পিস্তল হাতে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি হাসান মোল্লাকে আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি গুলি করতে দেখা যায়। তবে তাকে এখনও গ্রেপ্তার করা যায়নি। ঢাবি ক্যাম্পাস ছাড়াও যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অস্ত্র হাতে গুলি করতে দেখা যায় নিউমার্কেট, সায়েন্সল্যাব ও জিগাতলা এলাকায়। তাদের বেশিরভাগই হেলমেট পরে অস্ত্রবাজি করে। তাদেরও শনাক্ত করার কাজ চলছে।
গত ২ আগস্ট জুমার নামাজের পর মাইলস্টোন কলেজের সামনে পুলিশের সঙ্গে অন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় রাজধানীর উত্তরা। সেখানেও পুলিশের সঙ্গে সাধারণ পোশাকে ছাত্রদের ওপর গুলি চালায় হেলমেট পরিহিত অস্ত্রধারীরা।
মোহাম্মদপুর এলাকায় সাবেক কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ, সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব, জাহাঙ্গীর কবির নানকের ব্যক্তিগত সহকারী মাসুদুর রহমান বিপ্লবসহ অন্তত এক ডজন ব্যক্তিকে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখা যায় এক ভিডিওতে। অধিকাংশই হেলমেট পরা ছিল। তাদেরও খুঁজছে পুলিশ। আসিফ আহমেদ ভারতে পালিয়েছে বলে জানা গেছে।
সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা ছবি, ভিডিও ফুটেজ, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণ করে ২০ জন অস্ত্রধারীকে শনাক্ত করেছে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ। বেশিরভাগই আত্মগোপন করেছে।