সোমবার, ০৬:৪৮ অপরাহ্ন, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

মা–বাবাই কি বন্ধু ঠিক করে দেবেন

অনলাইন ডেস্কঃ
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
  • ৫৫ বার পঠিত

তিথলি আগে ক্লাসে ঢুকলে নাফিসার জন্য জায়গা রাখে। আর নাফিসা ঢুকলে তিথলির জন্য। পাশাপাশি বসে খুব যে কথা বলে, তা কিন্তু নয়। আসলে দুজনের পাশাপাশি বসে থাকতেও যেন ভালো লাগে। এই স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হওয়ার পর সবকিছু কিছু দিন নাফিসার বড় অচেনা লাগছিল। তিথলির সঙ্গে কখন যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল! তার পর থেকে আর খারাপ লাগে না। বাড়িতে বসে ছবি আঁকলে, সে ছবি স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে তিথলিকে দেখায়। তিথলিও স্কুলের নির্জন কোণে বসে নাফিসাকে গান গেয়ে শোনায়। টিফিন ভাগাভাগি তো আছেই। বড় আনন্দে কাটছিল স্কুলবেলা। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন তাল কেটে গেল।

একদিন আম্মু বলল, ‘ওই তিথলির সঙ্গেই তো দেখি সারা দিন লেগে থাকো। কেন, স্কুলে আর বন্ধু নেই?’ মায়ের গলায় ঝাঁজ দেখে নাফিসা অবাক। তিথলির সঙ্গে মেশার মধ্যে অপরাধ তো কিছু দেখে না। ‘ওর সঙ্গে মিশতে আমার ভালো লাগে আম্মু। কী শান্ত আর ভালো মেয়ে, জানো? কী সুন্দর গান করে।’

‘জানি তো তুমি তো সব সময় ও রকম মেয়েগুলোকেই পছন্দ করো। কেন, এলিনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারো না? ও তো ফার্স্টগার্ল। এ রকম মেয়ের সঙ্গে মিশলে নিজেও ভালো রেজাল্ট করতে পারবে।’

‘ও তো আমার সঙ্গে মেশে না আম্মু।’

‘মিশবে। আমি ওর আম্মুকে বলে দেব। ওর আম্মু, হাফসা ভাবি তো আমার খুব ঘনিষ্ঠ, আমি বলে দেব। তুমি নিজেই এলিনার সঙ্গে ভাব করে নেবে। আফটার অল, ও ফার্স্টগার্ল। এখন থেকে তুমি সব সময় সামনের বেঞ্চে ওর পাশে বসবে। ঠিক আছে?’

নাফিসার উত্তর দেওয়ার কিছু থাকে না। পরদিন থেকে এলিনার পাশে গিয়ে বসে। এলিনা কিছু বলে না, ওর মা বোধ হয় ওকে বলে রেখেছে। বসতে দেয়। তবে বিশেষ পাত্তা দেয় না। টিফিন ছুটির সময় এলিনা আর ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের পেছনে ঘুরঘুর করতে থাকে নাফিসা। অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে তিথলি। মন খারাপ করে। কিছু বলে না। নাফিসার ইচ্ছা করে ছুটে গিয়ে একবার তিথলিকে জড়িয়ে ধরতে। পারে না। আম্মুর রাগী চেহারাটা মনে পড়ে!

 

ছোটবেলার বন্ধুতা বড়বেলাতেও অটুট থাকুক। মডেল: হামিদ ও জুবেরি
ছোটবেলার বন্ধুতা বড়বেলাতেও অটুট থাকুক। মডেল: হামিদ ও জুবেরিছবি: কবির হোসেন
নাফিসা আর তিথলির মতো অজস্র উদাহরণ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। ছেলে বা মেয়ে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, এটাও ঠিক করে দিতে চান মা-বাবা-অভিভাবকেরা। কিন্তু নির্দেশনা মেনে তো বন্ধুত্ব হয় না। খুব পরিকল্পনা করেও হয় না। বন্ধুত্ব একটা আবেগ। এই আবেগ যখন দুই বা ততোধিক জনকে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট করে, তখনই গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। বিশেষ করে ছোটদের ক্ষেত্রে এটি একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত। বড়দের মতো হিসাব-নিকাশ যেমন তারা করে না, তেমনি স্বার্থচিন্তাও তাদের মধ্যে খুব একটা থাকে না। ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে বা বিত্তবান পরিবারের ছেলে–মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতালে আখেরে লাভ হবে, এ রকম চিন্তা শিশু-কিশোরদের মনে আসে না। কিন্তু মা–বাবা বা অভিভাবক হয়তো সন্তানের ভালো-মন্দ (পড়ুন, লাভক্ষতি) বিবেচনা করে তার বন্ধুও নির্বাচন করে দিতে চান। অনেক সময় নিজেদের বন্ধু বা ঘনিষ্ঠজনের সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার পরামর্শও দেন। এ জন্য জোরজবরদস্তি করতে থাকেন। এতে সুফল তো পাওয়া যায়ই না, বরং তার মধ্যে একধরনের হীনম্মন্যতা তৈরি হতে থাকে।

বিশিষ্ট মনোবিদ ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মনোরোগ বিভাগের প্রধান ডা. পঞ্চানন আচার্যের মতে, ‘মা-বাবা যদি সন্তানের বন্ধুত্বের জায়গাটিতে হস্তক্ষেপ করেন বা কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে তার নির্দেশনা দেন, তাতে সন্তান একটি বৃত্তে আটকে যায়। তার মধ্যে দ্বিধা বা বিভ্রান্তি তৈরি হয়। ফলে সে সহজে আর এই সহজ সম্পর্কটি গড়ে তুলতে পারে না। তার বন্ধুহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকে।’

ছোটবেলায় বন্ধু গড়ে না উঠলে বড়বেলায় নিজেকে অসহয় লাগতে পারে। মডেল: হামিদ ও জুবেরি
ছোটবেলায় বন্ধু গড়ে না উঠলে বড়বেলায় নিজেকে অসহয় লাগতে পারে। মডেল: হামিদ ও জুবেরিছবি: কবির হোসেন
তবে হ্যাঁ, মা-বাবা তো চাইবেনই তাঁর ছেলে বা মেয়ের যেন ‘অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’ না হয়। সে ক্ষেত্রে ডা. পঞ্চানন আচার্যের পরামর্শ হচ্ছে, ‘পরিবারে নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে। ভালো-মন্দ সম্পর্কে তাকে অবহিত করতে হবে। যেমন মাদক সেবনের কুফল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার বিপদ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে হবে। এতে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজেই
সে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। মা-বাবারও “ভিলেন” হওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।’

মোদ্দাকথা, ছোটদের আমরা যত ছোট ভাবি, আদতে তারা অত ছোট নয়। তারও ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ আছে। বন্ধু নির্বাচনের অধিকার আছে। নাফিসা–তিথলির বন্ধুত্বের মাঝখানে দেয়াল তুলে দিয়ে নাফিসার মা যে আঘাতটি দিয়েছেন, তা হয়তো ছোট্ট দুটি মেয়ের মনে চিরকালের জন্য গভীর ক্ষত তৈরি করবে। এটা বুঝতে পারার মতো সংবেদনশীল নন বেশির ভাগ অভিভাবক। প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে থাকা, খেলা, তার সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করা—এসব মনকে প্রফুল্ল রাখে, শরীরকেও সতেজ রাখে। তাই সন্তানকে তার মনের মতো বন্ধু নির্বাচন করতে দিন। সম্ভব হলে সেই বন্ধুকে আপনিও সন্তানস্নেহে আপন করে নিন।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com