জাতিসঙ্ঘের সংস্থাগুলোর প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি দুই মিনিটে বিশ্বব্যাপী একজন নারী গর্ভাধারণ বা প্রসবজনিত কারণে মারা যান।
প্রতিবেদনের ‘মাতৃমৃত্যুর হার’ নারী স্বাস্থ্যের জন্য উদ্ভূত উদ্বেগগুলোকে আবারো সামনে নিয়ে আসে। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলে মাতৃমৃত্যু হয় বেড়েছে বা আগের অবস্থায় রয়েছে (অবস্থার উন্নয়ন হয়নি)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) মহাপরিচালক ডা. তেদ্রোস আধানম গেব্রেইসাস এ বিষয়ে বলেন, ‘গর্ভাবস্থা একজন নারীর জীবনে অত্যন্ত আনন্দের ও মূল্যবান সময়; তাই এই সময়টা প্রতিটি নারীর জন্য ইতিবাচক অভিজ্ঞতা হওয়া উচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এখনো বিশ্বের কয়েক লাখ নারীর জন্য এটি একটি ভয়াবহ ও বিপজ্জনক অভিজ্ঞতা।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই নতুন পরিসংখ্যানগুলোতে বোঝা যায় প্রসবের আগে, প্রসবের সময় এবং পরে প্রতিটি নারী ও মেয়ের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগ থাকার গুরুত্ব কতটা এবং তারা যেন তাদের প্রজনন অধিকার পুরোপুরি প্রয়োগ করতে পারে তা নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি।’
২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জাতীয়, আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী মাতৃমৃত্যুর হার অন্তর্ভুক্ত করা এ প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী আনুমানিক দুই লাখ ৮৭ হাজার মাতৃমৃত্যু হয়েছে। এটি ২০১৬ সালের তিন লাখ নয় হাজার থেকে সামান্য হ্রাস পেয়েছে।
২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘের আটটি অঞ্চলের মধ্যে দুটিতে অর্থাৎ ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় মাতৃমৃত্যুর হার ১৭ শতাংশ বেড়েছে এবং ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে এ হার ১৫ শতাংশ বেড়েছে। অন্যত্র, এ হার আগের অবস্থায়ই রয়েছে।
তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ অবস্থা থেকে উত্তোরণ সম্ভব।
উদাহরণস্বরূপ, একই সময়ে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে মাতৃমৃত্যুর হার ৩৫ শতাংশ এবং মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় এ হার ১৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেছেন, ‘লাখ লাখ পরিবারের জন্য মাতৃমৃত্যুর ট্র্যাজেডির কারণে সন্তান জন্মদানের ঐশ্বরিক আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘একটি শিশুকে পৃথিবীতে আনার সময় কোনো মাকে যেন তার জীবন হারানোর ভয় না পেতে হয়। বিশেষ করে যখন সাধারণ জটিলতাগুলোর চিকিৎসার সুযোগ ও প্রযুক্তি আমাদের কাছে আছে। বিশ্বব্যাপী মায়েদের স্বাস্থ্যসেবার সুযোগের সমতা থাকা দরকার; তিনি যেই হোক বা যেখানেই থাকুক না কেন, নিরাপদ প্রসবের ন্যায্য সুযোগ ও তাদের পরিবারের সাথে একটি সুস্থ ভবিষ্যত কাটানোর অধিকার তাদেরও আছে।
মূলত বিশ্বের দরিদ্রতম অঞ্চলে এবং সঙ্ঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে মাতৃমৃত্যুর হার বেশি। ২০২০ সালের মোট মাতৃমৃত্যুর প্রায় ৭০ শতাংশই সাব-সাহারান আফ্রিকায় হয়েছিল।
গুরুতর মানবিক সঙ্কটের সম্মুখীন নয়টি দেশে মাতৃমৃত্যুর হার বিশ্বের গড় মাতৃমৃত্যুর দ্বিগুণেরও বেশি।
বিশ্বব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক গ্লোবাল ডিরেক্টর এবং গ্লোবাল ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটির ডিরেক্টর জুয়ান পাবলো উরিবে বলেন, ‘এ প্রতিবেদনটি বোঝায় যে নারী ও কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যের জন্য আমাদের কার্যক্রম বাড়ানো খুবই জরুরি।’
তিনি আরো বলেন, ‘তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা খাতে আরো বেশি বিনিয়োগ করা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা আরো স্থিতিস্থাপক ও শক্তিশালী করার মাধ্যমে আমরা অনেকের জীবন বাঁচাতে পারি।’
অধিক রক্তপাত, উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভাকালীন নানা সংক্রমণ, অনিরাপদ গর্ভপাত থেকে সৃষ্ট জটিলতা, এবং অন্তর্নিহিত রোগব্যাধী যা গর্ভাবস্থার কারণে বৃদ্ধি পেতে পারে (যেমন এইচআইভি/এইডস ও ম্যালেরিয়া) মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ।
এগুলো উন্নত স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে প্রতিরোধ ও নিরাময়যোগ্য।
কমিউনিটিকেন্দ্রিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নারী, শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের চাহিদা মেটাতে পারে এবং প্রসব ও প্রসব-পরবর্তী যত্ন, শিশুদের টিকা, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাগুলোতে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে।
কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় তহবিলের অভাব, প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব এবং চিকিৎসা প্রযুক্তির দুর্বল সরবরাহ চেইন এই বিষয়গুলোর অগ্রগতির জন্য হুমকিস্বরূপ।
বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী প্রসবপূর্ব আটবার চেকআপের চারটিরও সুযোগ পান না, প্রসবোত্তর প্রয়োজনীয় যত্ন পান না এবং প্রায় ২৭০ মিলিয়ন নারী আধুনিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণের সুযোগ পান না।
তাদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিশেষ করে কখন তারা সন্তান ধারণ করবেন সে সিদ্ধান্ত নেয়া, সন্তান জন্মদানের পরিকল্পনা ও স্থান এবং নিজেদের স্বাস্থ্য রক্ষা নিশ্চিত করা ইত্যাদিতে তাদের কোনো ভূমিকা পালনের সুযোগ দেয়া হয় না।
তবে আয়, শিক্ষা, জাতি বা জাতিগত বৈষম্যগুলো প্রান্তিক গর্ভবতী নারীদের জন্য এসব ঝুঁকি আরো বাড়ায়।
ইউএনএফপিএ-এর নির্বাহী পরিচালক ডা. নাটালিয়া কানেম বলেছেন, ‘এটা মেনে নেয়া যায় না যে এত বেশি সংখ্যক নারী গর্ভাবস্থা ও প্রসবের সময় মারা যাচ্ছেন। এক বছরে দুই লাখ ৮০ হাজারের বেশি প্রাণহানির ঘটনা সত্যিই অসংবেদনশীল।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা জরুরিভাবে পরিবার পরিকল্পনায় বিনিয়োগ করে এবং নয় লাখ মিডওয়াইফের বৈশ্বিক ঘাটতি পূরণ করে এ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে পারি। যাতে প্রতিটি নারী তার প্রয়োজনীয় জীবনরক্ষাকারী যত্নটুকু পেতে পারে। প্রতিরোধযোগ্য মাতৃমৃত্যু বন্ধ করার জন্য আমাদের কাছে সরঞ্জাম, জ্ঞান ও সম্পদ রয়েছে; আমাদের এখন রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।’
কোভিড-১৯ মহামারী মাতৃস্বাস্থ্যের অগ্রগতিকে আরো বাধাগ্রস্ত করেছে।
এই প্রতিবেদনে ২০২০ সাল পর্যন্ত তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। মাতৃমৃত্যুতে মহামারীর প্রকৃত প্রভাব বোঝার জন্য আরো তথ্যের প্রয়োজন।
তবে করোনা সংক্রমণ গর্ভাবস্থায় মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই বিশ্বের সকল দেশের গর্ভবতী নারীদের এবং যারা গর্ভধারণের পরিকল্পনা করছে তাদের; করোনা টিকা এবং কার্যকর প্রসবপূর্ব যত্নের সুযোগ রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ক বিভাগের জনসংখ্যা বিভাগের পরিচালক জন উইলমোথ বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো মাতৃমৃত্যুর হার কমানো।’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রতিরোধযোগ্য মাতৃমৃত্যুর অবসান ঘটাতে এবং মানসম্পন্ন মাতৃস্বাস্থ্য পরিচর্যায় সার্বজনীন সুযোগ প্রদানের জন্য টেকসই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা এবং শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। এটা নিশ্চিত করা আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব যে প্রতিটি মা প্রসবের সময় বেঁচে থাকবেন। যাতে সন্তান নিয়ে তারা আনন্দময় জীবন কাটাতে পারেন।’
প্রতিবেদনটিতে বোঝা যায় যে মাতৃমৃত্যু হ্রাস করার জন্য বিশ্ববাসীকে দ্রত পদক্ষেপ নিতে হবে। না হয় ২০৩০ সালের মধ্যে আরো এক মিলিয়নেরও বেশি নারীর জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে হবে।
সূত্র : ইউএনবি