বহু বছর ধরেই নানা শিল্পের সমাহার রয়েছে বরিশাল বিভাগের নদীবেষ্টিত পিরোজপুরে। যার একটি হলো সম্ভাবনাময় ক্রিকেট ম্যাট শিল্প। নারিকেলের ছোবড়ার পাকানো দড়ি দিয়ে প্রস্তুত হয় ক্রিকেট মাঠের ম্যাট। বর্তমানে এগুলো পিরোজপুর জেলার চাহিদা মিটিয়ে সারা দেশে সরবরাহ করা হচ্ছে। ম্যাটের পাশাপাশি নারিকেলের ছোবড়া থেকে তৈরি হয় পাপোশ।
জানা যায়, শক্ত মাটি দিয়ে বানানো সাধারণ ক্রিকেট পিচে বর্ষা মৌসুমে খেলা বেশ দুরূহ। তখন ম্যাচ বা অনুশীলন করার জন্য প্রয়োজন হয় কৃত্রিম পিচের। একসময় এগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও বর্তমানে দেশেই তৈরি হচ্ছে। স্বরূপকাঠির একজন উদ্যোক্তা একদল কুটির শিল্পী নিয়ে তৈরি শুরু করেন নারিকেলের ছোবড়ায় তৈরি কৃত্রিম পিচ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) আওতায় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিসিকের তত্ত্বাবধানে সেখানে বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছেন। তবে উদ্যেক্তারা জানান, ক্রিকেট ম্যাট তৈরির মূল উপাদান নরিকেলের ছোবড়া বর্তমানে চাহিদার তুলনায় কম পাওয়া যাচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, এই ছোবড়া শিল্পটি শত বছর পুরোনো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান সরকারের প্রতিষ্ঠিত দি পিপলস কয়ার ইন্ডাস্ট্রি ব্যক্তিমালিকানায় চলে যায়। বর্তমানে যা রানা-রাব্বী ইন্ডাস্ট্রি নামে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ শিল্প এলাকায় আরও পাঁচটি ছোবড়া শিল্পের আধুনিক কারখানা গড়ে উঠেছে। সেখানে দড়িও তৈরি হয়। দড়ি থেকে তৈরি করা হয় ক্রিকেট মাঠের ম্যাট।
বিসিক পিরোজপুরের তথ্যমতে, বর্তমানে বিসিক শিল্পনগরীতে মোট ১৬৭টি প্লট আছে, যার মধ্যে বরাদ্দকৃত প্লটের সংখ্যা ১৪৪টি, বরাদ্দকৃত শিল্প ইউনিট ৯৯টি, উৎপাদনরত শিল্প ইউনিট ৫৯টি এবং ২৬টি প্লট বরাদ্দের অপেক্ষায় আছে।
ক্রিকেট ম্যাট শ্রমিক আবদুর রহিম বলেন, এই ক্রিকেট ম্যাটের ওপর ক্রিকেট খেলা হয়। দড়ি পাকিয়ে ক্রিকেট ম্যাট বানানো হয়।
দি পিপলস কয়ার ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী মো. মহিউদ্দিন জানান, ক্রিকেট ম্যাট বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হয় যার যেখানে যেমন প্রয়োজন সেভাবে। একটি ম্যাটের দাম বর্তমানে ২৮-৩০ হাজার টাকা।
তিনি আরও জানান, নারিকেলের ছোবড়া সংগ্রহ করা হয় বাগেরহাট থেকে। তারপর এখানে রশি পাকিয়ে তৈরি করা হয় ম্যাট। এসব ম্যাটে ৩-৪ জন এবং পাপোশে ৫-৬ জন কাজ করেন। তবে ম্যাট বিক্রির গতি বেশ কম। ছোট পাপোশগুলো বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হয়।
পিরোজপুর জেলা বিসিক কর্মকর্তা মিল্টন বৈরাগী বলেন, আমরা উদ্যোক্তা তৈরি করি। উদ্যোক্তা চিহ্নিত করা থেকে শুরু করে তাদের প্রশিক্ষণ, ঋণ কার্যক্রম পর্যন্ত কাজ করে থাকি। আমাদের বিসিক শিল্পনগরী আছে। তাদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া, প্রজেক্ট প্রোফাইল, লেআউট প্ল্যানসহ সব কিছুই আমরা উদ্যোক্তদের জন্য করি।
তিনি আরও বলেন, উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্যগুলো নিয়ে মেলা বা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করি। আমরা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম করছি।
উল্লেখ্য, সুটিয়াকাঠির বেলতলা গ্রামের কুটির শিল্পীরা অনেকটা তাঁতের শাড়ির মতোই যত্নে তৈরি করেন কৃত্রিম পিচগুলো। তাঁতের কাপড়ে যেমন সুতা ব্যবহার করা হয়, তেমনি পিচের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় নারিকেলের ছোবড়া থেকে তৈরি সূক্ষ্ম রশি। স্থানীয় ভাষায় এই রশি পরিচিত ‘কাতরা’ নামে। পিচের ওপর দুই স্তর এবং নিচে এক স্তর কাতরা থাকে। মাঝখানে থাকে সুপারি গাছের কাণ্ড থেকে তৈরি ‘বেতি’। পিচের দৈর্ঘ্য ৬৬ ফুট, প্রস্থ প্রায় ৮ ফুট আর পুরু প্রায় আধা ইঞ্চি।
পিচ তৈরির সময় কাঠির মাথায় কাতরা রশি লাগিয়ে তা পৌঁছে দেওয়া হয় অপর প্রান্তের কর্মীর হাতে। তিনি তা নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে দেন। এই কাজের সময় টানটান সুতা থেকে বাতাসে মধুর টঙ্কার ধ্বনিত হয়।
৬৬ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি পিচ তৈরি করতে লাগে অন্তত ১০ হাজার টাকার কাতরা। একটি পিচ তৈরি করতে তিনজন শ্রমিককে কাজ করতে হয় অন্তত টানা ছয় দিন। সব মিলিয়ে একটি পিচ তৈরিতে ২০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। তোতা মিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী ছোবড়ার এই শক্তপোক্ত পিচে একনাগাড়ে ছয় মাস অনুশীলন করা যায়।