বৃহস্পতিবার, ০২:৫২ অপরাহ্ন, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

পশুর পাশাপাশি জবেহ হোক অন্তরের পশুত্ব

ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ৯ জুলাই, ২০২২
  • ১০৬ বার পঠিত

কোরবানির শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ত্যাগ। পবিত্র ইসলামের চতুর্থ রোকন পবিত্র হজ পালনের অংশ হিসেবে জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পশু উৎসর্গের মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পরম ত্যাগের আদর্শ স্থাপন এবং মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভে নিজের মনের সব আকুতি নিবেদন করেন। ওই কারণেই প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কোরবানির ঈদ পালন করেছেন এবং সামর্থ্যবান কোরবান বর্জনকারীদের সম্পর্কে সতর্কবার্তা নির্দেশিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ কোরবানির স্বীকৃতি প্রদান করে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক বিশেষ রীতি-পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওসব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যে সব আল্লাহ তাদের দান করেছেন।’ (সুরা আল হজ্জ-৩৪)

রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘কোরবানির দিনে আল্লাহর নিকট রক্ত প্রবাহিত (কোরবানি করা) অপেক্ষা প্রিয়তর কোনো কাজ নেই। অবশ্যই কেয়ামতের দিন (কোরবানিদাতার পাল্লায়) কোরবানির পশু তার শিং, পশম, তার ক্ষুরসহ হাজির হবে। কোরবানির রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার আগেই আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। তাই তোমরা প্রফুল্ল মনে কোরবানি করো।’ (তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)। নির্দিষ্ট বয়সী গরু, মহিষ, উট, ভেড়া, ছাগল ও দুম্বা ছাড়া অন্য কোনো পশু দিয়ে কোরবানি ইসলামে অনুমোদন নেই। দৈহিক ত্রুটিযুক্ত পশু যেমন- কানা, খোঁড়া, কানকাটা, লেজ কাটা, শিং ভাঙা ও পাগল পশু দ্বারা কোরবানি করা নিষিদ্ধ। (শামি, পঞ্চম খণ্ড) মহানবী (সা.) প্রিয় কন্যাকে কোরবানি সম্পর্কে বলেছেন, ‘হে ফাতিমা! আপন কোরবানির নিকট যাও। কোরবানির প্রথম রক্তবিন্দুতে তোমার সমস্ত গুনাহ মাফ হবে এবং জন্তুটি কেয়ামতের দিন সমুদয় রক্ত, মাংস ও শিং নিয়ে উপস্থিত হবে এবং তোমার আমলের পাল্লা ৭০ গুণ ভারী হবে।’ (ইসবাহানি)

‘ধর্ম’ শব্দটি ‘ধৃ’ ধাতু থেকে নেওয়া হলেও এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ধারণ করা। নিজের ও অপরের জীবন সমৃদ্ধিতে নিবেদিত সব কর্মেরই যোগফল হচ্ছে ধর্ম। আধুনিক দার্শনিকদের মতে, ধর্মের সংজ্ঞা অনেকটা জটিল ও ব্যাখ্যাসংবলিত। ‘হজরত নুহের প্লাবনের পর কাবা শরিফ পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিন হজরত ইব্রাহিম (আ.) হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। এ সময়েই তিনি আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং দুই পুত্রসহ (ইসমাইল ও ইসহাক) উভয়কেই ‘মুসলিম’ (আত্মনিবেদিত) বলে ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘোষণা বাণী থেকেই ইব্রাহিমের বংশধররা মুসলিম বা মুসলমান হিসেবে পরিচিত হন। (বাঙালির ধর্মচিন্তা :২০১৪)। হজরত ইব্রাহিম (আ.) মহান আল্লাহর কাছে সর্বোচ্চ আত্মসমর্পণকারীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং তাঁর পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই নিজের সর্বোত্তম প্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-এর জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। সেই থেকে মানুষের জীবনের পরিবর্তে পশুর প্রাণ নিবেদনের মাধ্যমেই পবিত্র কোরবানির প্রচলন শুরু হয়।

ইসলামের মূল রোকন রোজার পরেই হজের অবস্থান। এই জিলহজ মাসেই নির্দিষ্ট দিনগুলোয় পবিত্র কাবা শরিফ ও এর নিকটবর্তী আরাফাত-মিনা-মুজদালিফাসহ কয়েকটি পবিত্রতম স্থানে মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসুল (সা.)-এর নির্দেশ অনুযায়ী অবস্থান ও কার্যাদি নিবিড় একাত্মতার সঙ্গে এবং কায়মনোবাক্যে সব পাপ মুক্তির প্রার্থনা জানিয়ে হজব্রত পালন করেন। সুস্থ ও ভ্রমণে সক্ষম ব্যক্তি সম্পূর্ণ বৈধ বা হালাল উপার্জনে প্রয়োজনীয় খরচ বহন করার ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের হজব্রত পালন করা ইসলাম ধর্মে ফরজ বা বাধ্যতামূলক কর্তব্য হিসেবে নির্ধারিত। বৈধ ও অবৈধ উপার্জনের যথার্থ বিভাজন নির্ণয় ব্যতিরেকে অনৈতিক ও ইসলামে অনুমোদনহীন পন্থায় অর্জিত অর্থে প্রকৃতপক্ষে কোনো ব্যয় এবং কার্যক্রম কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। প্রিয় নবী রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অতি শিগগিরই একটি সময় এ রকম আসছে, যখন মানুষ এর কোনো পরোয়া করবে না যে, সম্পদ বৈধ কিংবা অবৈধ।’ [বুখারি :২০৫৯, আবু হুরাইরা (রা.)] অতএব, এই সম্পর্কে যথার্থ সজাগ থাকা এবং সে অনুযায়ী জীবনযাপন প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য।

আশঙ্কিত করোনার চতুর্থ ঢেউয়ের এই দুঃসময়ে ঈদুল আজহা উদযাপনে সংশ্নিষ্ট ধর্মীয় রীতিনীতির প্রতিপালন, নগর-গ্রাম স্থানান্তর-জনাসমাগম-লোক দেখানো মাংস বিতরণে যাতে সংক্রমণ বিস্তার ও প্রাণ নিধনের পরিসংখ্যান ঊর্ধ্বমুখী করে বাংলাদেশকে পর্যুদস্ত না করার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকার কর্তৃক নির্দেশিত স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিভিন্ন বিধিনিষেধ উপেক্ষিত হওয়া কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। অন্যথায়, ভয়াবহ অনিবার্য পরিণতি সংক্রমণ বিস্তার ও প্রাণহানির চৌহদ্দি নিয়ন্ত্রণবিহীন হয়ে পুনরায় পুরো জাতিরাষ্ট্রে দরিদ্রতা-কর্মহীনতা-ক্ষুধার অভিশপ্ত দৃশ্যপট তৈরি করবে। পবিত্র ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী সব ধার্মিক নাগরিক মহান স্রষ্টার নির্দেশিত বিধানগুলো সামর্থ্য অনুযায়ী অনুসরণ করতে অবশ্যই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে সংকটকালীন পবিত্র ধর্মের আনুষঙ্গিক কার্যকলাপ-জীবনধারা পরিবর্তনেরও বিশেষ দিকনির্দেশনা রয়েছে। উল্লেখ্য, বিষয়গুলো যথার্থ আমলে নিয়ে করোনা প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন এবং একই সঙ্গে আনন্দঘন ঈদ উদযাপন সুন্দর-স্বাভাবিক-সাবলীল ধারায় প্রতিপালিত হোক- এই প্রত্যাশায় দেশবাসীসহ বিশ্বের সব নাগরিককে ঈদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করছি।

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী: শিক্ষাবিদ, প্রাক্তন উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com