সারা দেশে হাজার হাজার বন্দীকে নিয়মিত আদালতে হাজির করে পুলিশ, কিন্তু বিচারে বিলম্বিত হয়েই চলছে- এতে করে বিচার বিভাগে জামিন পাওয়ার বিষয়টি বিচারব্যবস্থার দুর্নীতির অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। আইনের নীতি হলো- কেউ আদালতে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত সে নির্দোষ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। নির্দোষ আসামির জামিন পাওয়া তার ব্যক্তিস্বাধীনতার মৌলিক অধিকারও।
জামিন নামঞ্জুর করা শাসনতন্ত্রেই নিশ্চিত ব্যক্তির স্বাধীনতার পরিপন্থী। দুঃখজনক হলো, বিষয়টি মোটেও গুরুত্ব পাচ্ছে না। মৌলিক অধিকারের বিষয়টি বিবেচনাতেই নেয়া হয় না। বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনায় দুর্বলতা থাকায় কারো বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দিলেই তাকে জেলে শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। এ কার্যক্রম একেবারেই স্বাভাবিকভাবে চলছে। ‘পুলিশ মামলা দিয়েছে তাই কিছু দিন তো জেল খাটতেই হবে’।
আমি খুনি বা সন্ত্রাসীর মতো কঠিন অভিযোগে অভিযুক্তদের কথা বলছি না। সে ক্ষেত্রেও শুধু এফআইআর লিখলেই হবে না, তার অতীত ইতিহাস দেখতে হয়। আমাদের দেশে একটি খুনের জন্য ৯৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার দৃষ্টান্ত আছে। জেলে থেকে খুন করানো যে নিরাপদ মনে করা হয়েছে এমন মামলাও কোর্টের কাছে আসে। একজন বিচারকের কাছে বড় প্রশ্ন হলো- কাউকে জামিনে মুক্তি দিলে সমাজের জন্য বিপজ্জনক হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না।
নির্ধারিত শুনানির দিন বিচারাধীন মামলায় বন্দীদের একটি নির্দিষ্ট সময়ে কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়। বহুবিধ কারণে মামলার শুনানি দেরিতে হতে পারে। কোর্টে এনে তাকে হাজতে বন্দীদের মেঝেতে বসিয়ে রাখা হয়। সেখানে তাদের জন্য নেই কোনো টয়লেট-সুবিধা। মামলার শুনানি করতে আদালতের প্রস্তুতির জন্য বেশ কিছু সময় লাগে। তারিখের পর তারিখ পড়তে থাকে। কিন্তু শুনানি সম্ভব হয় না। তাই বারেবারে কোর্টে এনে হাজতে রাখা আসামিদের অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এর ওপর আসামি জেলে থাকায় বিচারকার্যক্রম সবসময় দ্রুত শেষ করার কোনো তাগিদ সরকারপক্ষ অনুভবও করে না। যদি চূড়ান্ত বিচারপ্রক্রিয়া ১০ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত সময়ও লেগে যায় তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আমাদের দেশে আদালতের কার্যক্রম যেভাবে চলে তাতে ন্যায়বিচার পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়েছে। মামলার শুনানির আগে বিভিন্ন পর্যায়ে সামান্য সুবিধা পাওয়ার জন্যও ঘুষ দিতে হয়। তবে এটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে, আমাদের পুলিশবাহিনীতে মানবিক বোধসম্পন্ন কেউ নেই।
মোদ্দাকথা, জামিন না পাওয়ার কারণে ফৌজদারি মামলায় অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বড় সুযোগ রয়েছে অনেকেরই। অভিযুক্ত ব্যক্তি তার অসুবিধার জন্য প্রতিবাদ করতেও মনোবল হারিয়ে ফেলে। অবশ্য, বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী প্রতিটি জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আদালত প্রাঙ্গণে বিশ্রামাগার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন; এটি প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণেও বিচারপ্রার্থীদের জন্য একটি বিশ্রামাগার নির্মাণাধীন। তবু সামগ্রিকভাবে এ উদ্যোগ কতটা সফল হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বন্দীদের প্রতি মানবিক আচরণ বা সেবা না দেয়ার দীর্ঘ দিনের অভ্যাস সহজে পরিবর্তন করা যাবে না। সাধারণত ফৌজদারি বিচারপ্রক্রিয়ায় আইনের চেয়ে অর্থের প্রয়োগ বেশি হয়ে থাকে। তাই বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি।
বিচারকরা যতই ন্যায়পরায়ণ হোন না কেন, বিচার বিভাগে বেশি দুর্নীতি হওয়ার প্রধান কারণ- অভিযুক্তরা সহজে জামিন পান না। অথচ এটি আমাদের সবার জানা, জামিনে থাকা ব্যক্তি সম্পূর্ণ মুক্ত নন। বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে তাকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। তার পাসপোর্ট আদালতের হেফাজতে রাখা যেতে পারে, যাতে তার পক্ষে বিদেশে যাওয়া সম্ভব না হয়। তার চলাফেরা আদালত নিয়ন্ত্রিত করতে পারেন। এমনকি জামিনে মুক্ত কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তার অনুপস্থিতিতে বিচার করতে অসুবিধা তো নেই।
সঙ্গত কারণে আমরা যদি অবিবেচক না হই তাহলে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি শাস্তি পাওয়ার চেয়ে বিচার প্রক্রিয়ার ত্রুটির জন্য বন্দী জীবনযাপন করে অধিকতর শাস্তি ভোগ করে থাকে। কোনো ব্যক্তিকে বিনাবিচারে আটক রেখে জামিনে মুক্তি না দিলে আমাদের মতো দরিদ্র দেশে তার ছেলেমেয়ে ও পরিবার-পরিজনের জন্য কী ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয় তা কোর্ট-আদালতের চিন্তা করতে হবে।
বিচারপতিরা দোষী ব্যক্তিদের যত কঠিন শাস্তি দিতে চান দিন; কিন্তু বিনাবিচারে কাউকে জেল খাটতে বাধ্য করা যে সুবিচার নয় তা স্বীকার করতে হবে। বিচারকরা নিষ্ঠুর হতে পারেন না। এখন প্রশ্ন হলো- জামিন না দিয়ে কেন রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থে হাজার হাজার বিচারাধীন বন্দীকে কারাগারে ভরণ-পোষণ করতে হবে? সেই সাথে তাদের চিকিৎসাসহ দেখাশোনার ভার নিতে হবে।
বিচারের আগে জেলে বন্দিজীবনে বাধ্য করা আইনি বিচার নয়- পুলিশি বিচার। সুবিচারের সুযোগ গ্রহণের জন্যও অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিনে বাইরে থাকা প্রয়োজন। অপরাধের অভিযোগ যদি এমন হয় যে, তাকে জামিন দেয়া হলে সমাজের জন্য বিপজ্জনক হবে কেবল সে ক্ষেত্রে জামিন না দেয়া যুক্তিসঙ্গত।
দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত জামিনে মুক্ত থাকার ব্যবস্থা সুবিচারেরই কথা। জামিন পাওয়ার অধিকার কার্যকর হলে দেখা যাবে অপরাধ হ্রাস পাবে। মিথ্যা মামলার সংখ্যাও কমবে। এটিই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
বিচারের অর্থই সৎসাহস।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট