আল্লাহ সৃষ্টির উন্মেষ ঘটান এবং পরবর্তীকালে তাঁর ইচ্ছামতো তাকে জটিল ও বৈচিত্র্যময় করে তুলেন। নিম্নবর্ণিত আয়াতগুলো থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ‘সৃজনশীল ক্রমবিকাশ’ আল্লাহর অন্যতম প্রধান সৃষ্টিকৌশল। যার গতিপথ আল্লাহর ইচ্ছানুসারে নিম্ন থেকে উচ্চতর স্তর ও সরল থেকে জটিলতার দিকে। সৃষ্টি থেকে স্রষ্টার দিকে।
আল-কুরআনের মতে, একটি বিশ্ব-জগৎ সৃষ্টির মধ্যেই কেবল আল্লাহর সৃষ্টি প্রক্রিয়া সীমাবদ্ধ নয়। এই মহাবিশ্ব তাঁর সীমাহীন ধারাবাহিক সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার কেবল একটি গ্রন্থি। সময়ের সম্মুখ গতির সাথে সম্প্রসারণের মাধ্যমে তিনি তাঁর সৃষ্টিশৈলীকে বিকশিত করেছেন। আর সময়ের পশ্চাৎগতির সাথে সঙ্কোচনের মাধ্যমে সব কিছু ধ্বংস করে তিনি তাকে তার মূলের দিকেই ফিরিয়ে নেবেন। আর এভাবেই আল্লাহর ইচ্ছানুসারে নতুন সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়ে শেষ হবে সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার একটি পর্ব। এ যেন অনেকটা লেখা শেষে পাণ্ডুলিপির মতো স্থান-কালকে গুটিয়ে নেয়া। যাবতীয় সৃষ্টি ও ধ্বংসের মূল পরিকল্পনা আল্লাহর কাছে একটি সুস্পষ্ট গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। আল্লাহ বলেন-
‘(এটি এমন এক দিন) যেদিন আমি আসমানসমূহকে গুটিয়ে নেবো, ঠিক যেভাবে কিতাবসমূহ গুটিয়ে ফেলা হয়; যেভাবে আমি একদিন এ সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম সেভাবেই আমি আবার এর পুনরাবৃত্তি ঘটাব, এটি (এমন এক) ওয়াদা, (যা) পালন করা আমার ওপর জরুরি; আর এ কাজ তো আমি করবই।’ (২১ : ১০৪)
কালের (পরিক্রমায়) কোনো সময় মানুষের ওপর দিয়ে এমন অতিবাহিত হয়েছে যখন সে এবং তার (অস্তিত্ব) উল্লেখ করার মতো কোনো বিষয়ই ছিল না। (৭০ : ১)
ওরা কি দেখে না, আসমানসমূহ ও পৃথিবী (এক সময়) ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল, অতঃপর আমিই এদের উভয়কে পৃথক করে দিয়েছি এবং আমি জীবিত সব কিছুকেই পানি দিয়ে সৃষ্টি করেছি, (এসব কিছু জানার পরও) তারা ঈমান আনবে না? ’ (২১:৩০)
প্রচণ্ড শক্তির মাধ্যমে আমি আসমান বানিয়েছি এবং আমরাই একে প্রসারিত করছি।’ (৫১ : ৪৭)
‘আল্লাহ প্রত্যেক চলন্ত জীবকে পানি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাদের কতক বুকে ভর দিয়ে চলে, কতক দু’পায়ে ভর দিয়ে চলে এবং কতক চারপায়ে ভর দিয়ে চলে; আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু করতে সক্ষম।’ (২৪ : ৪৫)
‘আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দু রূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে মাংসপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর সেই মাংসপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে মাংস দিয়ে আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে নতুনরূপে দাঁড় করিয়েছি। নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কত কল্যাণময়।’ (২৩ : ১২-১৪)
‘এ লোকেরা কি লক্ষ করে না, কিভাবে আল্লাহ প্রথমবার তাঁর সৃষ্টিকে অস্তিত্ব দান করলেন, অতঃপর তার পুনরাবৃত্তি ঘটান (কিভাবে তাকে আবার তার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন), এ কাজটি আল্লাহর কাছে নিতান্ত সহজ।’ (২৯ : ১৯)
‘আল্লাহ (নিজেই তাঁর) সৃষ্টিকে অস্তিত্ব দান করেন, আবার তিনিই তাকে তার (মূলের) দিকে ফিরিয়ে নেন, অতঃপর তোমাদের তাঁর কাছেই ফিরিয়ে নেয়া হবে।’ (৩০ : ১১)
‘যারা (আল্লাহর এসব কুদরত) অস্বীকার করে তারা বলে, আমাদের ওপর কখনোই কিয়ামত আসবে না; আপনি (এদের) বলুন, আমার প্রভুর কসম, হ্যাঁ, অবশ্যই তা তোমাদের ওপর আপতিত হবে, (আমার প্রভু) অদৃশ্য (জগৎ) সম্পর্কে অবহিত, এ আকাশমণ্ডলী ও জমিনের অণু-পরমাণু তার চেয়েও ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ কোনো কিছুই তাঁর (জ্ঞানসীমার) অগোচরে নয়, এমন কিছুই নেই যা সুস্পষ্ট গ্রন্থে (লিপিবদ্ধ) নেই।’ (৩৪ : ৩)
(এই যে জমিন) তা থেকেই আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি, তাতেই আমি তোমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাব এবং তা থেকেই আমি তোমাদের দ্বিতীয়বার বের করে আনব।’ (২০ : ৫৫)
‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আসমান ও জমিনের স্রষ্টা এবং ফেরেশতাদের করেছেন বার্তাবাহক- তারা দুই দুই, তিন তিন ও চার চার পাখাবিশিষ্ট। তিনি সৃষ্টির মধ্যে যা ইচ্ছা যোগ করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সক্ষম।’ (৩৫ : ১)
‘আসমান ও জমিনের সমুদয় শক্তিই তো আল্লাহর হাতে এবং তিনিই পরাক্রমশালী ও প্রবল প্রজ্ঞাময়।’ (৪৮ : ৭)
‘এই আকাশমণ্ডলী ও ভ‚মণ্ডলে যত কিছু আছে সবাই নিজ নিজ প্রয়োজন তাঁর কাছেই চায়; (আর) তিনি প্রতিদিন (প্রতি মুহূর্ত) কোনো না কোনো কাজে তৎপর রয়েছেন।’ (৫৫ : ২৯)
উপরোক্ত আয়াতগুলো একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলেই স্পষ্ট হয় যে, এগুলো সমন্বিতভাবে ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
মহা-বিস্ফোরণ ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে মহাজাগতিক ভ্রুণের ক্রমবিকাশ।’ (২১:৩০, ৫১ : ৪৭), মানব জাতির অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে রূপান্তর, মাটি ও পানির সমন্বয়ে রাসায়নিক রূপান্তরের মাধ্যমে জীবনের উদ্ভব, মাতৃজঠরে ভ্রুণের ক্রমবিকাশ এবং এক বিশেষ পর্যায়ে তার মধ্যে রুহ সংস্থাপন, জীববৈচিত্র্য, মৃত্যু ও পুনরুত্থানসহ প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে এখানে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। আর আল্লাহর এই সৃজনশীল ক্রমবিকাশের মূল চালিকাশক্তি হলো আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও ইচ্ছাশক্তি। এ থেকে বুঝা যায়, মানুষের ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের ধারণা কুরআনিক ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক নয়; বরং সঙ্গতিপূর্ণ। আল্লাহর সৃষ্টিকৌশল ও সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কিত উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে এটি স্পষ্ট যে, আল্লাহ নিয়ন্ত্রিত সৃজনশীল ক্রমবিকাশ একটি অনিবার্য বাস্তবতা। ডারউইনের জীবজগতে ক্রমবিকাশের ধারণার মধ্যে সেই বাস্তবতাই আংশিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
ডারউইনের বিবর্তনবাদের আলোকে যারা মানব সৃষ্টিতে আল্লাহর ভ‚মিকা অস্বীকার করে লক্ষ্য-উদ্দেশ্যহীন অন্ধ প্রাকৃতিক নিয়মের ওপর ন্যস্ত করে- তারা আসলে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্নিহিত সত্যকেই বিকৃত করে। আল-কুরআন এদের প্রতি সুস্পষ্ট সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে-
‘যারা আমার নিদর্শনসমূহের অন্তর্নিহিত সত্যকে বিকৃত করে তারা কেউই আমার দৃষ্টির বাইরে নয়।’ (৪১ : ৪১)
‘পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি সব কিছুকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। (চাই তা) জমিনের উৎপন্ন উদ্ভিদ থেকে হোক, কিংবা (হোক) স্বয়ং তাদের নিজেদের থেকে, অথবা এমন সব সৃষ্টি থেকে হোক, যাদের (সম্পর্কে) মানুষ এখনো আদৌ (কিছু) জানেই না।’ (৩৬ : ৩৬)
পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাব ও তার উৎস সম্পর্কে মানুষ আজও বিশেষ কিছু জানে না। এর উৎস পৃথিবীতে না মহাবিশ্বে, গ্রহ-নক্ষত্র না তারকালোকে সেই অনিশ্চিত সম্ভাবনা ও বাস্তবতার প্রতি কুরআনের এই ইঙ্গিত মানুষের জন্য চিন্তা-গবেষণার এক বিশাল ক্ষেত্র উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
আকাশ, পৃথিবী ও মহাশূন্যের সমন্বিত বাস্তবতার সুনির্দিষ্ট প্রকাশ হলো পৃথিবীর বুকে প্রাণের আবির্ভাব। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব থেকে মানব জাতির আবির্ভাব পর্যন্ত পুরো প্রাণিজগৎকে আল্লাহর সৃজনশীল ক্রমবিকাশের এক সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এই ক্রমবিকাশের প্রত্যেক স্তরে প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর হুকুম কার্যকরী থেকে তাকে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
সৃজনশীল ক্রমবিকাশের প্রথম পর্যায়ের সর্বোচ্চ প্রকাশ হলো মহাবিশ্বের পূর্বনির্ধারিত স্থানসমূহে সীমিত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন বুদ্ধিমান প্রাণীর আবির্ভাব। কুরআন যাদের আদমের বংশধর বলছে। আর দ্বিতীয় পর্যায় হলো সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক উন্নয়নের মাধ্যমে আদি-সত্তার সাথে পুনর্মিলন।
প্রথম মানুষ হিসেবে হজরত আদম আ: ও কুরআনে বর্ণিত তাঁর সৃষ্টি-প্রক্রিয়া আসলে আল্লাহ নির্দেশিত বস্তুজগতের সৃজনশীল ক্রমবিকাশের প্রথম পর্যায়ের। কবি ইকবালের সৃজনশীল ক্রমবিকাশের তত্ত্ব অনুসারে : ‘বস্তু-জগতের সর্ব নিম্ন স্তর থেকে ক্রমবিকাশের পথ ধরে আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে মানুষের ব্যক্তি-সত্তার উন্নয়নের মাধ্যমেই আদি-সত্তার প্রকাশ ঘটে। নিজস্ব ফিতরা বা মৌলিক প্রকৃতি সচেনতাই হলো মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সৃষ্টিগতভাবে মানব-প্রকৃতির মূল প্রোথিত আছে অতি-প্রাকৃত দৈব-সত্তার গভীরে এবং তার প্রকৃতি গত বৈশিষ্ট্যই হলো ক্রমান্বয়ে উৎকর্ষতা সাধন। তার সৃজনশীল ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করে সে নিজেকে ক্রমাগত পরিশুদ্ধ করে তুলে।’
প্রতিশ্রুত বিচার-দিবস বা পুনরুত্থান দিবস সৃজনশীল ক্রমবিকাশের সর্বোচ্চ স্তর যখন ব্যক্তি-সত্তা আদি-সত্তায় বিলীন হয়ে যায়। ‘কুন’-এই আদেশটির মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর সৃজনশীল ক্রমবিকাশের চক্রটিতে গতিবেগ সঞ্চার করেন- যার প্রথম পর্যায়ের সর্বোচ্চ প্রকাশ মহাবিশ্বের কয়েকটি নির্ধারিত স্থানে আল্লাহর ইচ্ছানুসারে বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সচেতন প্রাণীর আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে এবং পরবর্তী পর্যায়ে পুরো সৃষ্টিকে তার মূলের দিকে ধাবিত করে ব্যক্তি-সত্তার সাথে আদি-সত্তার সম্মিলন ঘটানো- ইকবালের ভাষায় ব্যক্তি-সত্তার আধ্যাত্মিক উন্নয়নের মাধ্যমে তাকে ক্রমবিকাশের সর্বোচ্চ স্তরে আদি-সত্তার (Super Ego) পর্যায়ে উন্নীত করা। পৃথিবী সৃষ্টি ও ধ্বংসের মধ্যে সময়ের ব্যবধান পার্থিব হিসেবে কোটি কোটি বছর হলেও আল্লাহর কাছে মুহূর্ত মাত্র।
পার্থিব জীবনে এক রহস্যময় পর্দা স্রষ্টাকে সৃষ্টি থেকে আলাদা করে রাখে। পুনরুত্থান দিবসে এই পর্দা উঠে যাবে এবং সব রহস্য উন্মোচিত হবে। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যকার এই আপাত বিচ্ছেদ ও মানবজাতি সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অপ্রকাশিত রাখার মধ্যেই এই রহস্য নিহিত আছে। প্রতিক্ষণ প্রতি মুহূর্তে স্রষ্টার করুণা ধারায় স্নাত মানুষ আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ ও সংশয়ের মধ্যে আছে! এর থেকে আশ্চর্যের বিষয় আর কী হতে পারে? সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে বিদ্যমান এই রহস্যময় পর্দা উন্মোচনের পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহর সৃজনশীল ক্রমবিকাশের ধারা চলমান থাকবে।
নয়াদিগন্ত