বিদ্যুতের অন্ধকার বা লোডশেডিংকে দূরে ঠেলে দিতে নজিরবিহীন মূল্য গণনার পরও সেই অন্ধকার বারবার ফিরে আসছে। বলা হচ্ছে বিদ্যুৎ ব্যবহার কমিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু এক যুগের বেশি সময় ধরে এত অর্থ ব্যয় করেও কেন বিদ্যুৎ খাত জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি? কেন বিদ্যুৎ খাত দেশের অর্থনীতির জন্য গলার কাঁটা হয়ে আছে? কেন বিদ্যুৎ না নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে পিডিবিকে? কেন সাশ্রয়ী খরচের দেশী বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ব্যয়বহুল দেশী-বিদেশী বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে এই খাতকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে?
গত এক যুগ ধরে দায়মুক্তি দিয়ে জ্বালানি খাতে যেসব চুক্তি করা হয়েছে এখন তার মূল্য দেয়ার জন্য যেন সময় হাজির হয়েছে। রাষ্ট্রের জ্বালানি নিরাপত্তার নামে দীর্ঘমেয়াদি চাহিদা সরবরাহের যে দৃশ্যপট আঁকা হয়েছে তার কোনোটাই এখন ঠিক থাকছে না । সম্ভাব্য এই দৃশ্যপটকে সামনে রেখে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য চুক্তি করা হয়েছে, কিন্তু উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালনের জন্য প্রয়োজনীয় সঞ্চালন লাইন করা হয়নি। আবার বিতরণ লাইন না থাকায় সঞ্চালনের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরও সেই বিদ্যুৎ ভোক্তাপর্যায়ে পৌঁছানো যাচ্ছেনা। কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? এর পরিণতিইবা কী দাঁড়াবে- এসবের কিছুটা গভীরে যাবার প্রচেষ্টা রয়েছে এই লেখায়।
কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা?
সরকারের পক্ষ থেকে ১৩ বছরের অর্জনের বিবরণীতে সবচেয়ে বড় অংশজুড়ে ছিল বিদ্যুৎ খাত। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার তার কার্যক্রম শুরু করার আগে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট, যা ২০২২ সালে এসে ৪১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ক্যাপটিপসহ ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। ২০০৯ সালে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল তিন হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট আর ২০২২ সালে সর্বোচ্চ উৎপাদন ৩৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন গত ১০ জুলাই ২০২২ তারিখে ছিল ১১ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট। ২০০৯ এবং ২০২২ সালের ব্যবধানে সঞ্চালন লাইনের বিস্তৃতি বেড়েছে ৬৯.৩ শতাংশ আর বিতরণ লাইন বেড়েছে ১৪০.৮ শতাংশ। একই সময়ে বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা বেড়েছে ২৯৫ শতাংশ। এই বৃদ্ধির মধ্যে একটির সাথে আরেকটির কোনো সামঞ্জস্য থাকেনি।
বিদ্যুতের উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত চারটি মৌলিক স্তর রয়েছে। উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ নেটওয়ার্ক ও গ্রাহক সংযোগ। ভোক্তাপর্যায়ে যে চাহিদা রয়েছে উৎপাদিত হওয়ার পরও সঞ্চালন ও বিতরণ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে তা না পৌঁছালে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহার না হয়ে অপচয় হয়। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি চাহিদা সরবরাহ দৃশ্যপট সামনে রেখে উৎপাদন পরিকল্পনা নেয়া হয়। এই পরিকল্পনার কোথাও সমন্বয় না থাকলে অর্থাৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সব ঠিকঠাকমতো সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও যদি সঞ্চালন বা বিতরণ লাইনের পরিকল্পনার সাথে এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয় তাহলে বিপত্তি দেখা দেয়। আবার উৎপাদন পরিকল্পনায় পরিণামদর্শিতা না থাকলে সেই পরিকল্পনা হয়ে দাঁড়ায় গলার কাঁটা।
সরকারের দেয়া কয়েকটি পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করা হলে আমরা কোন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছি তার ব্যাপারে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। বিদ্যুতের প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন ক্ষমতা এবং কার্যকর উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবধান গ্রহণযোগ্য ধরা হয়। চলতি শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত বাংলাদেশেও এর বড় রকমের ব্যতিক্রম ছিল না।
সর্বশেষ সরকারি তথ্য অনুসারে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ প্লান্টের প্রতিষ্ঠাকালীন উৎপাদন ক্ষমতা আর সর্বোচ্চ উৎপাদনের ব্যবধান ছিল ৩৪ শতাংশের মতো। ২০২২ সালে সেটি উন্নীত হয় সোয়া ৪২ শতাংশে।
বিদ্যুৎ বিভাগের সর্বশেষ চিত্রে দেখা যায়, ২০০৯ ও ২০২২ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইন যেখানে মাত্র ৬৯ শতাংশ এবং বিতরণ নেটওয়ার্ক ১৪০ শতাংশ বেড়েছে সেখানে উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে ৪১৭ শতাংশ। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে সঞ্চালন ও বিতরণ নেটওয়ার্ক না থাকায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। এতে বসিয়ে বসিয়ে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ক্যাপাসিটি চার্জের টাকা দেয়া হচ্ছে।
মহাপরিকল্পনার বিভ্রাট
২০০৫, ২০১০ এবং ২০১৬ সালে বাংলাদেশের পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান (পিএসএমপি) নামে তিনটি মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়। এসব দেখে, আমরা ১৫ বছরের প্রকৃত চাহিদা তুলনা করতে পারি।
পিএসএমপি ২০০৫-এ চাহিদার পূর্বাভাস তৈরি করা হয়েছিল জিডিপির সাথে বিদ্যুতের চাহিদার ঐতিহাসিক পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। ২০২৫ সালের মধ্যে জিডিপি বৃদ্ধির তিনটি পূর্বাভাস ছিল। পিএসএমপি ২০১০ এ ৬.৯ শতাংশ স্থির এবং টেকসই গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে নেয়া হয় ২০ বছরের জন্য।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে বিদ্যুৎ বৃদ্ধির ট্যাগিংয়ের ক্ষেত্রে একাধিক বিপত্তি রয়েছে।
প্রথমত, বৃদ্ধির কোনোটিই রৈখিক নয়। দ্বিতীয়ত, নীতি পরিবর্তনের কারণে জিডিপি বৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের চাহিদার মধ্যে অতীতের সম্পর্ক সত্য নাও থাকতে পারে। উচ্চতর জিডিপি বৃদ্ধির জন্য বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধির প্রয়োজন হবে; কিন্তু জিডিপি বৃদ্ধির পূর্বাভাস নিজেই অনেক অনিশ্চিত উপাদানের সাপেক্ষে করা হয়।
২০২০ সালে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অধীনে ২০২৫ সালের জন্য ১০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি চাহিদার অনুমানসহ ২০১৬ সালে চূড়ান্ত করা পিএসএমপি সংশোধন করা হচ্ছে। ২০২০ সালের গ্রীষ্মকালে, বিদ্যুতের সর্বোচ্চ প্রকৃত চাহিদা প্রায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট ছিল যেখানে ২০২১-এর জন্য প্রত্যাশিত প্রয়োজন ছিল, ২৪ হাজার মেগাওয়াট। এটি অপ্রয়োজনীয় উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ ক্ষমতার পথ প্রশস্ত করে, যা রাষ্ট্রের জন্য হয় বেশ ব্যয়বহুল।
২০০৫ এবং ২০১০ সালের মহাপরিকল্পনায় ২০১০ সালের বিদ্যুতের সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয় যথাক্রমে ছয় হাজার ৬০৮ এবং ছয় হাজার ৪৫৪ মেগাওয়াট। বাস্তবে এই সময়ে বিদ্যুৎ চাহিদা দাঁড়ায় চার হাজার ৬০৬ মেগাওয়াট। ২০০৫ সালেরটা বাদ দেয়া হলেও যে বছরের মহাপরিকল্পনা সেই বছরেই চাহিদা প্রদর্শিত সম্ভাবনার চেয়ে এক তৃতীয়াংশ কম হওয়ার বিষয়টি বিস্ময়কর। ২০১০ সালের মহাপরিকল্পনা অনুসারে ২০১৮ সালের বিদ্যুতের চাহিদা নিরূপণ করা হয় ১৪ হাজার ১৪ মেগাওয়াট। বাস্তবে এই সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা দেখানো হয় এর চেয়ে ২২ শতাংশ কম। ২০২০ সালে ২০১০ সালের তুলনায় সাড়ে ২৫ শতাংশ এবং ২০১৬ সালের মহাপরিকল্পনার তুলনায় ১০ শতাংশ চাহিদা বাস্তবে কম ছিল। ২০২১ সালে চলমান মহাপরিকল্পনার চাহিদার তুলনায় বাস্তব চাহিদার ব্যবধান আরো বেড়েছে। ২০২৫ সালে ২২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে। এ সময়ের প্রদর্শিত চাহিদা ও বাস্তব চাহিদার ব্যবধান আরো বাড়বে।
মহাপরিকল্পনার আরেকটি বড় বিচ্যুতির দিক হলো বিদ্যুৎ উৎপাদনে কী ধরনের জ্বালানি বা উপকরণ ব্যবহার করা হবে সেটি। ২০০৭ সালে অভ্যন্তরীণ পর্র্যায়ে গ্যাস ঘাটতি শুরু হবার পর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের প্রাথমিক জ্বালানি নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ এখন গ্যাসের ৪৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করে। স্বাভাবিকভাবেই, বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের পরিকল্পনার জন্য দেশের প্রাথমিক শক্তির ধরন এবং পরিমাণের পূর্বাভাস দিতে হবে। ২০০৫ সালের আগে, ৯৪ শতাংশ বিদ্যুৎ স্থানীয় প্রাকৃতিক গ্যাস দ্বারা উৎপাদিত হয়; বর্তমানে, ৩৪ শতাংশ তেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থা রয়েছে যদিও মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থার ৫৪ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক প্ল্যান্ট থাকা সত্ত্বেও গ্যাসের মাধ্যমে প্রকৃত নেট বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় ৭১ শতাংশ (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৯/২০)।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) প্রথম দিকে বাংলাদেশের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলোর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর সহায়তায় ২০০০ সাল থেকে প্রথম দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। পিএসএমপি ২০০৫ এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে নেয়া হয় যে, বাংলাদেশে অদূরভবিষ্যতে গ্যাসের সীমাহীন সরবরাহ থাকবে। কয়লা এবং তরল জ্বালানির সীমিত ব্যবহারসহ সম্পূর্ণ পরিকল্পনাটি একটি গ্যাসভিত্তিক দৃশ্যের ওপর ভিত্তি করে ছিল। পিএসএমপির প্রস্তাবিত শুরুর তারিখের দুই বছরের মধ্যে ৩০০ এমএমসিএফডি গ্যাসের ঘাটতি দেখা দেয়। এটি ভবিষ্যতের গ্যাস উৎপাদনের পূর্বাভাস দেয়ার ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার একটি স্পষ্ট ব্যর্থতা ছিল। ফলে বাংলাদেশকে ২০ বছরের পিএসএমপি ২০০৫, প্রবর্তনের তিন বছরের মধ্যে পরিত্যাগ করতে হয়।
পরবর্তী নতুন ২০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা পিএসএমপি ২০১০, গ্রহণ করা হয় জাইকার সহায়তায়। প্রাথমিক শক্তি সরবরাহ পরিকল্পনায় পরিবর্তন ঘটে এতে। এ পরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লা থেকে আসবে মর্মে উল্লেখ করা হয়, যার ৩০ শতাংশ আসার কথা স্থানীয় সরবরাহ থেকে। পরিকল্পনাটিতে বিদ্যুৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাশ্রয়ী হিসাবে কয়লার ওপর ব্যাপক জোর দেয়া হয়। এর মধ্যে প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই চুক্তি করা হয়। পিএসএমপি ২০১০ এর মতো আবার জ্বালানি মিশ্রণের ভবিষ্যদ্বাণী করতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়া হয়। এতে, অনুমান করা হয় যে, ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ ২০২০ সালে কয়লা থেকে আসবে। অথচ ২০২০ সালে জ্বালানি মিশ্রণে গ্যাস এবং তরল জ্বালানির প্রাধান্য ছিল।
পিএসএমপি ২০১০ প্রবর্তনের ঠিক পরে, বিদ্যুৎ খাতের জন্য একটি নতুন পরিকল্পনার প্রয়োজন দেখা দেয়। এর প্রধান কারণগুলো ছিল : প্রধানমন্ত্রীর আপাতত কোনো দেশীয় কয়লা উত্তোলন করা হবে না মর্মে একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান, যা নীতি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। আর সেই সাথে ছিল উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অনুমান; অধিক বিদ্যুৎ আমদানি, অতিরিক্ত পারমাণবিক ও গ্যাস ক্ষমতা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাড়ানোর পরিকল্পনা।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পনাগুলোতে দেখা যায় যে, প্রাথমিক শক্তির ব্যবহার এবং চাহিদার পূর্বাভাস বিবেচনায় প্রতি পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ পরিকল্পনার পরিবর্তন ঘটেছে। প্রেক্ষাপট এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, সেই সাথে অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো পরিকল্পনাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
বাংলাদেশের জন্য, ২০১০ সালে কয়লার ওপর জোর দেয়া কিছু বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করেছিল; কিন্তু ২০১৬ সালে জ্বালানি পছন্দের পরিবর্তনের ফলে এটি পরিত্যক্ত হয়।
উদ্বৃত্ত ক্ষমতা
বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এবং বিদ্যুতের প্রকৃত ব্যবহার বৃদ্ধিতে বিশেষ আগ্রহ দেখা যায়। সরকারিভাবে ২০২১ সালে ২৪ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। অথচ ২০২০ সালের শীতকালে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ১১ হাজার মেগাওয়াটের মতো।
এ সময় বিপিডিবি গ্রিড উৎপাদন ক্ষমতা ২১ হাজার মেগাওয়াট বলে দাবি করে। বিদ্যুতের চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে কেন এই স্পষ্ট অমিল তা রহস্যজনক। যখন কোনো পরিকল্পনায় চাহিদার পূর্বাভাস দেখায়, তখন এটি নিশ্চিত করে যে প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। একটি দক্ষ সিস্টেমে ১০ শতাংশ উদ্বৃত্ত ক্ষমতা গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতা অর্জনের বাংলাদেশের বর্তমান অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা পূর্ববর্তী পিএসএমপি ২০১০ এর পূর্বাভাসের চেয়ে প্রায় সাত হাজার মেগাওয়াট বেশি আর পিএসএমপি ২০১৬ এর চেয়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট বেশি। এভাবে একটি উচ্চ লক্ষ্য রাজনৈতিক স্বার্থ দ্বারা চালিত বলে মনে হতে পারে। কারণ এই লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপনে চুক্তি করা হয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, অর্থনীতির গতির সাথে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়েনি কেন? জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে খাতভিত্তিক বিদ্যুৎ বৃদ্ধির দিকে তাকালে প্রকৃত বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি ও জিডিপির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শিল্প প্রবৃদ্ধি জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে মেলেনি। বিদ্যুতের জন্য আবাসিক চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলেও, ২০১৭ সাল থেকে শিল্প চাহিদা স্থবির হয়ে পড়ে। আর আবাসিক বৃদ্ধি অর্থনীতিতে কোনো পরিমাপযোগ্য প্রভাব ফেলেনি।
৬ সেপ্টেম্বর ২০২০-এ, প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে, কার্যকর ক্ষমতা ছিল ১৫ হাজার মেগাওয়াটের মতো। এর মানে ১৩ শতাংশ অতিরিক্ত ক্ষমতা ছিল। সে হিসেবে বাংলাদেশ যদি সর্বোচ্চ ব্যবহার মৌসুমে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারে, তা নীতিনির্ধারকদের জন্য লাল সঙ্কেততুল্য হবে। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করার আগে পর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং অদক্ষ ইউনিটগুলোকে অবসর নেওয়ার জন্য ব্যবস্থা না নেয়া হলে বিপিডিবিকে মোটা অঙ্কের খরচ বহন করতে হবে যা গ্রাহকদের ওপর শেষ পর্যন্ত চাপবে।
২০২০ সালের বাংলাদেশের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন চাহিদার তুলনা করলে, পাঁচ হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের ব্যবধান রয়েছে। অন্য কথায়, গ্রীষ্ম এবং শীতের মধ্যে চাহিদার একটি বিশাল ব্যবধান রয়েছে। বর্তমানে, শীতের চার থেকে পাঁচ মাসে এই অতিরিক্ত ক্ষমতা স্ট্যান্ডবাই রাখা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো উপায় নেই। তবে সরকারি কেন্দ্র দিয়ে এটি রাখা হলে অলস সময়ের জন্য কোনো মূল্য পরিশোধ করতে হয় না।
ভবিষ্যতে মেগা প্রকল্প অনুমোদনে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে, পাইপলাইনে থাকা পাওয়ার সেক্টরের মেগা প্রকল্পগুলো যদি জাতীয় পাওয়ার গ্রিডে সরবরাহ করা শুরু করে, তাহলে বাংলাদেশকে এই সময়ের মধ্যে তার বিদ্যুৎ খরচ দ্বিগুণ করতে হবে। এই দৃশ্য একটি দুঃস্বপ্ন পরিস্থিতি হবে। বাস্তবে, বিপুল পরিমাণ অতিরিক্ত বিদ্যুৎ নিষ্ক্রিয় বসে থাকবে, যার ফলে রাজকোষে বিপুল পরিমাণ খরচ হবে। বৃহৎ বিদ্যুৎ প্রকল্প যুক্ত করার পরিবর্তে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা স্থাপন করা যেতে পারে। এটি কম খরচের বিকল্পের জন্য বর্তমান লোডকেন্দ্র এবং ভবিষ্যৎ বৃদ্ধির ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে পারে।
বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ড ২০০৭ সালে ৪০০ এমএমসিএফডি উৎপাদন শুরু করে এবং তার পরও সরবরাহের ঘাটতি ছিল ৩০০ এমএমসিএফডি। পুনর্নবীকরণ করা পিএমএমপি ২০১৬ পিএমএমপি ২০১০-এর ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সেক্টরভিত্তিক বিশ্লেষণের একটি কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে গেছে এবং জাইকার সহায়তায় আবার পিএমএমপি ২০১৬ হিসাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। নতুন পরিকল্পনায় ৩৫ শতাংশ গ্যাস, ৩৫ শতাংশ কয়লা, ১৫ শতাংশ বিদ্যুৎ আমদানি/নবায়নযোগ্য, ১০ শতাংশ পারমাণবিক এবং ৫ শতাংশ তেল হিসাবে ২০৪১ সালের জন্য একটি সর্বোত্তম জ্বালানি মিশ্রণের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।
আদানির বিদ্যুৎহীন মূল্য দিয়ে দুটি কেন্দ্র
ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা বাংলাদেশের জন্য লাভজনক, না অধিক ব্যয়ের ফাঁদ তা নিয়ে চলছে বিতর্ক। ২৫ বছরের মেয়াদে এই বিদ্যুৎ কিনতে সম্ভাব্য ব্যয় হবে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় নেয়া উদ্যোগে আদানি পাওয়ার ঝাড়খণ্ড প্রদেশের গোড্ডা জেলায় এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের একটি তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে, যার বেশির ভাগই বাংলাদেশে রফতানি হবে।
‘আদানি গোড্ডা কোল পাওয়ার প্ল্যান্ট : অ্যান অ্যাকিলিস হিল অব দ্য পাওয়ার সেক্টর অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, ডিসেম্বর ’২২ পর্যন্ত চার মাসের ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) হবে ১৪১ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার (এক হাজার ২১৯ কোটি টাকা)। ২০১৭ সালে সই হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, মোদির ঘনিষ্ঠ ভারতীয় উদ্যোক্তা আদানি গৌতম প্রতিষ্ঠিত আদানি গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্টের ইউনিট প্রতি ক্যাপাসিটি চার্জ তিন টাকা ২৬ পয়সা। তবে, বাংলাদেশে একধরনের প্ল্যান্টের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ দুই টাকা ৮৩ পয়সা।
চুক্তি অনুযায়ী, আদানি পাওয়ার ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২৫ বছরের জন্য এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। আদানি পাওয়ার গোড্ডা থেকে ইন্টারকানেকশন পয়েন্ট পর্যন্ত ১০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন স্থাপন করবে। এই পয়েন্ট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের রোহনপুর সাবস্টেশন পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের জন্য ২২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।
বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটারনাল ডেট ও ভারতভিত্তিক গ্রোথওয়াচের এই যৌথ গবেষণায় বলা হয়, আদানি গোড্ডার বিদ্যুৎ আমদানিকৃত অন্যান্য বিদ্যুতের চেয়ে ৫৬ দশমিক ২ শতাংশ, আমদানিকৃত কয়লা বিদ্যুতের চেয়ে ৩৬ দশমিক ৯ শতাংশ ও দেশীয় কয়লা বিদ্যুতের চেয়ে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি ব্যয়বহুল হবে। প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, চুক্তির ২৫ বছরের মেয়াদকালের মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে আদানি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি অর্থ দিতে হবে বাংলাদেশকে, যা তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য যথেষ্ট। আর নতুন কয়লা প্ল্যান্ট নির্মাণের আনুমানিক খরচ প্রতি কিলোওয়াট তিন হাজার ৫০০ ডলার। এই হিসাবে আদানিকে সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহারের সময়ে গ্রিডে পর্যাপ্ত শক্তি নিশ্চিত রাখার জন্য বিদ্যুৎ না নিয়েই প্রদেয় মাশুল বা ক্যাপাসিটি চার্র্জ বাবদ যে অর্থ দেয়া হবে তা দিয়ে ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশে নির্মাণ করা সম্ভব।
১৩ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ ৭০ হাজার কোটি টাকা
বর্তমানে বাংলাদেশের গ্রিড বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন গত ১৬ এপ্রিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। গড় উৎপাদন গ্রীষ্মকালে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। শীতে কমে সাত থেকে আট হাজারে নেমে আসে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার একটা বড় অংশ বসে থাকে। বিদ্যুৎ না কিনলেও চুক্তি অনুসারে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে একটা চার্জ দিতে হয়। গত ১৩ বছরে বিদ্যুতে এ ধরনের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। এটি দিয়ে প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব। ২০২০-২১ অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে ১৩ হাজার ১৫৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৮৫২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা।
বর্তমানে ভারত থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে বাংলাদেশ। এই বিদ্যুতের আমদানি ব্যয়ের ৪০ শতাংশই যায় ক্যাপাসিটি চার্জে। বিশেষ করে শীতকালে যখন চাহিদা কমে যায় তখন আমদানি কমে আসে। বিদ্যুৎ কম এলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। ২০১৩ সালে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়। চুক্তি অনুসারে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ভারতকে দেয়া ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৫০০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৯২১ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮৪০ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭-তে ছিল ৬২৭ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮-তে ৯৮৭ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯-এ ১ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা এবং ২০১৯-২০ সালে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল এক হাজার ৪৯২ কোটি টাকা।
‘বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটারনাল ডেবট বা বিডবিøউজিইডি’-এর গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৭টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বছরের অধিকাংশ সময় অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৩ হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে; যা আগের বছরের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি। বসে বসে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে টাকা আদায় করা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অর্থনীতির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিডব্লিউজিইডির তথ্য অনুসারে, ৬৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন-ক্ষমতাসম্পন্ন শীর্ষ ১২টি কোম্পানি আট হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে, যা ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রদত্ত মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এ তালিকার এক নম্বরে রয়েছে সামিট গ্রুপ। তাদের পরে পর্যায়ক্রমে রয়েছে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল, ইডিআরএ পাওয়ার হোল্ডিং, ইউনাইটেড গ্রুপ, কেপিসিএল, বাংলা ট্র্যাক, ওরিয়ন গ্রুপ, হোসাফ গ্রুপ, মোহাম্মদী গ্রুপ, ম্যাক্স গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ ও এপিআর এনার্জি।
বিশ্বব্যাপী বিশেষ প্রয়োজনে ১০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস রাখা হচ্ছে আদর্শ নিয়ম। জাপানে ১০ শতাংশ অলস বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এটা বেশি হলে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। এসবের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে গিয়েই বিদ্যুৎ খাত দেউলিয়া হচ্ছে।
নতুন সঙ্কট
বাংলাদেশের পরিকল্পনা বিভ্রম ও সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থের প্রভাবে বিদ্যুৎ খাতে যে একধরনের অরাজক অবস্থা এখন সৃষ্টি হয়েছে তার সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে জ্বালানি আমদানি সঙ্কট। সরকার দেশের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির ব্যাপারে কাতার বা ওমানের সাথে পুরো জ্বালানি চাহিদা মেটানের মতো দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ চুক্তি না করে এর অংশ বিশেষ সিঙ্গাপুরভিত্তিক স্পট জ্বালানি বাজার থেকে নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে সাত ডলারে যে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে তা এখন স্পট মার্কেট থেকে ৩৮ ডলারে পর্যন্ত কিনতে হচ্ছে। এতে চাপ বাড়ছে ডলারের রিজার্ভে। দেশে ডলার সঙ্কট সামলাতে গিয়ে স্পট মার্কেটের এই জ্বালানি কেনা বন্ধ করে দেয়ার ফলে ৫০০ মেগাওয়াটের মতো ঘাটতি বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় সরকার লম্বা সময়ের জন্য অন্ধকার বা লোডশেডিংয়ের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে।
সরকারের ক্রান্তিকালে যেখানে দরকার ছিল প্রশাসন চালানোর ব্যয়ের লাগাম টানা, বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জের মতো অপখরচ থামানো, অপ্রয়োজনীয় রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি বাতিল করা। সেটি না করে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করে এখন জনগণের ওপর লোডশেডিং চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। সরকার ২০১৪-১৫ অর্র্থবছর থেকে এ পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাড়ে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে, শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরেই দিয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। নবায়ন করা হয়েছে পাঁচটি অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র যেগুলোকে সারা বছর অলস রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে তিন বছরের জন্য দেয়া লাইসেন্স ১৭ বছর পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির অনুমতি পেয়েছে এ ধরনের কোনো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই সর্বনাশা পথের ইতি ঘটিয়ে পরিণামদর্শি বিদ্যুৎনীতি নেয়া হলে জ্বালানির জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করার প্রয়োজন হবে না। এ জন্য অফ শোর ও অন শোরে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন নিশ্চিত করা আর সে সাথে দেশীয় কয়লা উত্তোলনের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন হবে। তা না হলে শ্রীলঙ্কার মতো অরাজক পরিস্থিতি বাংলাদেশেও হাতছানি দিতে থাকবে।
mrkmmb@gmail.com