দেশের শেয়ারবাজার দীর্ঘদিন ধরেই সংকটে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের মনে স্বস্তি ফিরবে- এমন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। বাজারে হঠাৎ হঠাৎ দরপতন, লেনদেনে অস্বাভাবিক মন্দা এবং অনিশ্চিত বিনিয়োগ পরিবেশের কারণে পুরো বাজারটি যেন টালমাটাল হয়ে পড়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আগে ডলার সংকট ছিল তীব্র। আমদানি ব্যাহত হওয়া, জ্বালানি ও কাঁচামালের বিপর্যস্ত সরবরাহ, চলতি হিসাবের ঘাটতি- সব মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাপ ছিল অসহনীয়। এখন অনেক দিকেই উন্নতি হয়েছে। রেমিট্যান্স বাড়ছে, ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরে আসছে, রিজার্ভের ওপর চাপ কিছুটা কমেছে। অথচ একই সময়ে শেয়ারবাজারের অবস্থার উন্নতি হয়নি; বরং আস্থাহীনতার কারণে বাজারে ভর করছে আরও অনিশ্চয়তা।
বাজারসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কাক্সিক্ষত নেতৃত্ব দিতে পারছে না। অতীতে অনিয়ম-দুর্নীতি, তথ্য গোপন, কারসাজি- এসব কারণে যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা কাটাতে নিয়ন্ত্রকের কাছ থেকে শক্ত বার্তা আশা করেছিলেন বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকার কারণে সেই আস্থা গড়ে উঠছে না। শেয়ারবাজারের বড় অংশীজন মনে করেন, আস্থা ফেরাতে হলে প্রথমেই বাজারমধ্যস্থতাকারী এবং ব্রোকারদের সঙ্গে বিশ্বাসভিত্তিক সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। বিনিয়োগকারীরা যে বিষয়গুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন, সেগুলো অন্তত আপাতত সরিয়ে রাখা দরকার।
বর্তমান দরপতনের মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো বিনিয়োগকারীদের সামর্থ্য হ্রাস। টানা ক্ষতির কারণে ছোট বিনিয়োগকারীরা কার্যত পুঁজিশূন্য অবস্থায়। অপরদিকে বড় বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল নীতি ও ভবিষ্যৎ অর্থনীতির দিকনির্দেশনায় আস্থা পাচ্ছেন না। তারা নিশ্চিত নন- আগামী কয়েক মাসে মুদ্রানীতি, শিল্পনীতিতে স্থিরতা থাকবে কি না; কিংবা বাজার তদারকিতে ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে কি না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা নতুন বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন না।
এই পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারে দেখা দিয়েছে লেনদেন খরা। গত সপ্তাহে চার কার্যদিবসে দরপতন হয়েছে, ৪৫টির বিপরীতে ৩২৫টির দর কমেছে। শুধু ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জেই মূলধন কমেছে ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। লেনদেন নেমে এসেছে ২০০-২৬০ কোটি টাকার ঘরে- যা গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। সিএসইতেও একই চিত্র- লেনদেন কম, সূচক কমছে, বিনিয়োগকারীদের মনোবল ভেঙে পড়ছে।
মূল প্রশ্ন হলো- এই পরিস্থিতি বদলাবে কীভাবে? অর্থনীতির অন্য খাতগুলোর মতো শেয়ারবাজারেও উন্নতি চাইলে প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে আস্থার পুনর্গঠন। বাজারে অনিশ্চয়তা থাকলে বিনিয়োগ কখনই বাড়বে না। আর্থিক বাজার এমন জায়গা যেখানে আস্থা একবার ভেঙে গেলে তা ফিরিয়ে আনতে সময় লাগে; কিন্তু আস্থা পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু না করলে বাজার আরও স্থবির হয়ে পড়বে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা আরও দৃশ্যমান ও বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। ২০১০ সালের ধস থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক অনিয়ম- সব ধরনের কারসাজি ও দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। বিশেষ করে যেসব কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে বা তথ্য গোপন করেছে- তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আস্থা ফিরবে না।
বাজারে তারল্য বাড়াতে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান, পেনশন ফান্ড বা অন্যান্য বড় বিনিয়োগকারীকে বাজারে সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে বাজারে নতুন পুঁজি প্রবাহিত হবে।
বিনিয়োগকারীদের জন্য তথ্যপ্রকাশ আরও আধুনিক, দ্রুত ও নির্ভুল করা জরুরি। সঠিক তথ্য সব সময়ই আস্থা বাড়ায়। কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন, ঘোষণা, ঝুঁকি- এসব বিষয়ে স্বচ্ছতায় ঘাটতি থাকলে বিনিয়োগ কখনই চাঙা হবে না।
সবশেষে বাজারমধ্যস্থতাকারী, ব্রোকার, মার্চেন্ট ব্যাংক, তালিকাভুক্ত কোম্পানি এবং নিয়ন্ত্রক- সব পক্ষের মধ্যে সমন্বয় জরুরি। একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে এ সংকটের সমাধান হবে না। বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে হলে সবার মধ্যে সহযোগিতা এবং সমন্বিত রোডম্যাপ দরকার।
শেয়ারবাজার একটি দেশের অর্থনীতির আয়না। এই আয়না যদি ধোঁয়াটে থাকে, অর্থনীতি কখনই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সামনে এগোতে পারে না। বর্তমান সংকট কাটাতে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে আস্থা পুনর্গঠন, নীতি-স্থিতিশীলতা এবং কঠোর নজরদারির পথে হাঁটতে হবে। আস্থা ফিরলেই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে- এটাই মূল কথা।