নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। চাল-ডাল থেকে শুরু করে মাছ-মাংস, ডিম, তরিতরকারি- বেড়েই চলেছে সবকিছুর দাম। এক বছরের ব্যবধানে ক্রেতাদের খরচের চাপ বেড়েছে অনেকখানি; তা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। সবচেয়ে বেকায়দায় রয়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। বাজার সামলাতে আমদানির অনুমতিসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। তবুও এসব পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, পণ্যমূল্য বাড়ার প্রবণতা দেখা দিলে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী তৎপর হয়ে ওঠে এবং অতিমাত্রায় দাম বাড়িয়ে দিয়ে ফায়দা লোটে। বর্তমানে বাজার মনিটরিং অনেকটাই দুর্বল, যার সুযোগ নিচ্ছে এসব অসাধু।
এই সময়ে বেশি ভোগাচ্ছে চালের বাড়তি দাম। বোরো মৌসুমে ভালো উৎপাদনের পর বাজার কিছুটা নিম্নমুখী হলেও তা ছিল ক্ষণস্থায়ী, কিছুদিন পার হতেই আবার দাম বেড়েছে। মিনিকেট চাল প্রতি কেজি ৮০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। মোটা চাল কিনতে হচ্ছে মোটা দামে; প্রতি কেজি ৫৬ থেকে ৬০ টাকা। আটার দামও বেড়েছে। খোলা আটা প্রতি কেজি ৪০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৮-৫০ টাকা হয়েছে। প্যাকেটজাত দুই কেজি আটা ৯৫ টাকা থেকে বেড়ে ১১০-১১৫ টাকা হয়েছে। নতুন করে মশুর ডালের (ছোট দানা) দাম বেড়ে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। ভোজ্যতেলের বাজারেও খরচের চাপ কম নয়।
কেবল চাল, ডাল, আটা, তেল নয়, দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে মাংস, দুধ, ডিম ও মসলাও। গত এক বছরের বাজারচিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকটা বাদে বেশির ভাগ পণ্যে ভোক্তার খরচ অনেকখানি বেড়েছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সর্বশেষ বাজার প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে মূল্যবৃদ্ধির চিত্র।
সংস্থাটির হিসাবে গত বছর সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি বছর সেপ্টেম্বরে রাজধানীর বাজারে সরু চালের দাম ১১ দশমিক ১১ শতাংশ, মাঝারি চালের দাম ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম সাড়ে ৭ শতাংশ বেড়েছে। খোলা আটার দাম ১৪ দশমিক ১২ শতাংশ ও প্যাকেটজাত আটার দাম ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ বেড়েছে। এক বছরে সয়াবিন তেলের দাম প্রায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে। মসুর ডালের (ছোট দানা) দাম ১৭ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর এই সময়ের তুলনায় এখন পেঁয়াজ, রসুন, জিরার দাম কম থাকলেও এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ ইত্যাদি মসলার দাম বেড়েছে। এক বছরে গরু-খাসির মাংসের পাশাপাশি মুরগির দাম বেড়েছে। এর মধ্যে এই সময়ে ব্রয়লারের দাম ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ বেড়েছে। গুঁড়া দুধের দাম ৪ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এক বছরের ব্যবধানে প্রতিদিনের দরকারি পণ্যের দাম এতটা বেড়ে যাওয়ায় বেজায় চাপে রয়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। মধ্যবিত্তরাও হিমশিম খাচ্ছেন।
রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা মো. মোস্তাক আহমেদ বলেন, ডাল-ভাত খেয়ে টিকে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। কদমতলী এলাকার অটোরিকশাচালক মো. কাজল মিয়া বলেন, চালের দাম অত্যধিক। আগে যে চাল ৫৫-৬০ টাকায় কিনছি, এখন তা ৬৪-৭৫ টাকা। তরিতরকারির দামও বাড়ছে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কিছু পণ্যে শুল্ক ছাড়সহ আমদানির কথা ভাবা হচ্ছে। ডিম এক ডজন ১৫০ টাকা এবং পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৯০ টাকা ছাড়ালে পণ্য দুটিতে শুল্ক ছাড় ও আমদানির সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। কাঁচামরিচের আমদানিতেও শুল্ক সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া সবজির বাজারে ভোক্তা অধিদপ্তরকে নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
কারওয়ানবাজারের চালের পাইকারি বিক্রেতা মোশাররফ হোসেন বলেন, এখন আর মৌসুম অনুযায়ী দাম বাড়ে-কমে না, এখন বড় কোম্পানি আর মিলগুলো যেভাবে বাজার চালায়, সেভাবে চলে। তারাই নানা কারণ দেখিয়ে দাম বাড়ান। আর সেভাবেই গোটা বাজার চলছে। আমদানি করেও কাজ হয় না।
আটার মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মালিবাগ বাজারের ব্যবসায়ী মো. শিপন বলেন, গমের সরবরাহে টান পড়ায় আটার দাম বেড়েছে। কোম্পানিগুলো দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
শ্যামবাজারের পেঁয়াজের পাইকারি ব্যবসায়ী কানাই সাহা বলেন, কৃষকের হাতে পেঁয়াজ শেষ হতেই মজুদদাররা বেশি দামে পেঁয়াজ ছাড়া শুরু করেন। এতেই দাম তরতর করে বেড়ে যায়। এখন আমদানির খবরে দাম কিছুটা কমেছে। তবে যতটা বেড়েছে এখনও ততটা কমেনি।
ভোক্ত অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, বাজার মনিটরিং বলতে গেলে নেই। প্রশাসনের ভূমিকা দুর্বল। অসাধু চক্রগুলো এর সুযোগ নিচ্ছে। আমরা দেখতে পাই, কোনো কারণে একটি পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করলে অসাধু ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগে দাম আরও বাড়িয়ে দিয়ে অল্প সময়ে মোটা অঙ্কের বাড়তি লাভ তুলে নিচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে নজরদারি বাড়াতে হবে। আমদানি হলেও কারা আমদানি করছে, সেগুলো কোথায় যাচ্ছে, কত দামে বাজারে ছাড়া হচ্ছে এসবের ওপর মনিটরিং থাকতে হবে।