প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পরবর্তী বৈঠকে বিএনপি তার দলীয় অবস্থান আবার তুলে ধরবে। জামায়াতে ইসলামী বাদে জুলাই অভ্যুত্থানের অংশীজন অন্য দলগুলোর সঙ্গে বিএনপি জোট করতে পারে। নির্বাচনে জয়ী হলে একসঙ্গে সরকার গঠনও করবে।
গত সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন আলোচনা হয়েছে বলে দলীয় সূত্র সমকালকে জানিয়েছে। বৈঠক থেকে সংস্কারের বিষয়ে ছাড়ের কোনো আভাস মেলেনি। লন্ডন থেকে বৈঠকে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
দলটির মতে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট ও গণপরিষদের দাবি বাস্তবসম্মত নয়। সনদকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া ও আদালতের প্রশ্ন তোলার সুযোগ রহিত করার অঙ্গীকারও গ্রহণযোগ্য নয়। যেসব সংস্কার কার্যকরে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, সেগুলো পরবর্তী সংসদে হবে। বাকিগুলো সরকার চাইলে নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কার্যকর করতে পারে।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন ও এনসিপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য সংস্কারের যেসব শর্ত দিয়েছে, তাতে গুরুত্ব দেবে না বিএনপি।
সনদ নিয়ে বিএনপির অবস্থান
গত ১৬ আগস্ট রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া দেয় ঐকমত্য কমিশন। এতে দুই দফার সংলাপে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠতার মতামতে সিদ্ধান্ত দিয়েছে কমিশন। খসড়ায় আট দফা অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, সনদকে আইন ও সংবিধানের ওপর প্রাধান্য, আদালতের প্রশ্নমুক্ত রাখা এবং নির্বাচনের আগে বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার কার্যকরের কথা বলা হয়েছে।
গত ২০ আগস্ট বিএনপি ৩৫ পৃষ্ঠার মতামতে জানিয়েছে, সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। এর ওপরে সনদকে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। আদালতের প্রশ্ন তোলার সুযোগ বন্ধ করে নাগরিক অধিকার খর্ব করা যাবে না।
সংস্কারের ৮৪ সিদ্ধান্তের ৭৩টিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য রয়েছে। ভোটের অনুপাতে (পিআর) উচ্চকক্ষ গঠন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে সাংবিধানিক কমিটি গঠনসহ ৯টি সিদ্ধান্তে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।
সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য নেই। বিএনপি আগামী সংসদে সাংবিধানিক সংস্কার চাইলেও জামায়াত চায় গণভোট বা রাষ্ট্রপতি ঘোষণা। এনসিপি আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে গণপরিষদ গঠন করে সেখান সংস্কার কার্যকর চায়। এর পর গণপরিষদই সংসদে রূপান্তর হবে। জামায়াত সনদকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে এবং আদালতের প্রশ্নমুক্ত রাখার পক্ষে।
সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়– এ পথ খুঁজতে গত রোববার আইন উপদেষ্টা, অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে কমিশন। এতে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরিতে গণভোট এবং বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ জারির আলোচনা হয়। গণভোট ও সংসদ নির্বাচন একই দিনে হতে পারে কিনা– এ আলোচনাও হয়।
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ সনদের সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের অবহিত করেন।
বিএনপি মনে করছে, গণভোট বা গণপরিষদের যৌক্তিকতা নেই। কারণ, গণভোট হয় সুনির্দিষ্ট একটি ইস্যুতে। জুলাই সনদে ৮৪টি সিদ্ধান্ত রয়েছে। তাই গণভোট হতে পারে না। বাংলাদেশে সাংবিধানিক শূন্যতা না থাকায় গণপরিষদেরও প্রশ্ন আসে না।
বিএনপি মনে করছে, সনদের অঙ্গীকারই মূল বিষয়। সনদে রাজনৈতিক দলগুলো সই বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। কোনো দল অঙ্গীকার ভঙ্গ করলে পরে জনগণ ভোটের মাধ্যমে জবাব দেবে।
বৈঠক সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে জটিলতা চায় না বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ঐকমত্য হয়েছে, যা চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে কার্যকর হবে। আগামী নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হবে।
সনদ সম্পর্কে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অঙ্গীকারনামার কিছু বিষয় অযৌক্তিক মনে করছে বিএনপি। ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনার সময় দলীয় বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হবে। সনদ সংবিধানের ওপরে স্থান পায়– এমন অঙ্গীকার গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি অবস্থানে পৌঁছাতে হবে।
যেসব ‘ছাড়’ দিয়েছে বিএনপি
ঐকমত্য কমিশনের প্রাথমিক প্রস্তাব ছিল, এক ব্যক্তি দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়। বিএনপি এর বিরুদ্ধে ছিল। পরে দলটি মেনে নেয়, কেউ ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না। বিএনপি দ্বিতীয় দফার সংলাপে সাংবিধানিক কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের সুপারিশও মেনে নেয়।
হাইকোর্টের বেঞ্চ বিভাগীয় শহরে নেওয়ার প্রস্তাবে প্রথমে রাজি ছিল না বিএনপি। পরে আলোচনার মাধ্যমে তা মেনে নেয়। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দিতে রাজি হয়েছে দলটি। এ ছাড়া সরাসরি আসনে নারীদের অন্তত ৫ শতাংশ মনোনয়নের বিধানেও দলটি অবস্থান শিথিল করে একমত হয়।
নির্বাচনবিরোধী বক্তব্যে বিচলিত নয়
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়। ভোটের অনুপাত (পিআর) পদ্ধতি চালু না হলে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না কিংবা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না– কয়েকটি দলের এমন বক্তব্যকে বিএনপি গুরুত্ব দিতে চায় না। দলটি মনে করছে, রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব বক্তব্য, মতামতে উদ্বেগের কিছু নেই। গণতন্ত্রে নানা মত থাকাই স্বাভাবিক। দলগুলো সাফল্য পেতে এসব বক্তব্য দিচ্ছে বলে বিএনপির মূল্যায়ন। স্থায়ী কমিটি মনে করে, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হবে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, রমজানের এক সপ্তাহ আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা নেই। দু-একটি দল বিভ্রান্তির চেষ্টা করছে, যা তাদের কৌশল হতে পারে।
পিআর পদ্ধতি ও গণপরিষদের দাবিকে রাজনৈতিক কৌশল আখ্যা দিয়ে তিনি বলেছেন, এগুলো মাঠ গরম করার বক্তব্য দিচ্ছে। দেশে নির্বাচনী আমেজ বিরাজ করছে। যারা নির্বাচনের বিপক্ষে কথা বলবে, তারা রাজনীতি থেকে মাইনাস হয়ে যাবে। কোনো দল নির্বাচনে অংশ না নিলে তা তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা।
জোট ও প্রশাসন নিয়ে আলোচনা
স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পুলিশ ও প্রশাসনের রদবদল নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে একাধিক নেতা বলেন, এসব রদবদলে বিএনপির সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, এ নিয়ে স্থায়ী কমিটি থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। বলা হয়, এসবে বিএনপির সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে সরকার চাইলে সহযোগিতা করতে পারে বিএনপি। এ ক্ষেত্রে দল সুনির্দিষ্ট কাউকে দায়িত্ব দেবে, যিনি এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ বা সমন্বয় করবেন।
বৈঠকে কয়েকটি ইসলামী দলের সঙ্গে যোগাযোগ এবং তাদের সঙ্গে জোট করতে করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের নিয়ে জোট হতে পারে। কয়েকটি ইসলামী ঘরানার দলের সঙ্গেও জোট হতে পারে। তবে তা চূড়ান্ত নয়। জামায়াতের সঙ্গে জোটের সুযোগ নেই।
বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। ভার্চুয়ালি যোগ দেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস ও নজরুল ইসলাম খান।