বুধবার, ০৮:২৪ অপরাহ্ন, ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ই শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে তীব্র মতবিরোধ

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০২৫
  • ৬ বার পঠিত

চব্বিশের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর বহুল কাঙ্ক্ষিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর খসড়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ও মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। গতকাল এ নিয়ে দলগুলো তাদের নিজস্ব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কেউ চায় আইনি কাঠামো। কেউ চায় রাজনৈতিক দলগুলোর বিগত দিনের আন্দোলনের ভূমিকার স্বীকৃতি। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি স্পষ্টভাবে কিছু বলেনি। তবে আরও পর্যবেক্ষণ করে মতামত জানাবে। জামায়াতে ইসলামী বলছে, জুলাই সনদের খসড়া কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়। সেখানে দলগুলোর ভূমিকা উল্লেখ নেই। এটি বিপজ্জনক। অন্যদিকে, জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, আলোচনার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা ছাড়াই তারা (কমিশন) জুলাই সনদের খসড়া প্রকাশ করেছ। এটি আমরা গ্রহণ করতে পারি না। অন্যান্য দলও মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। গত সোমবার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫-এর খসড়া ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যার একটি কপি কালবেলার কাছেও এসেছে। রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই খসড়া সনদে বিগত দিনে বিএনপি, জামায়াতসহ প্রতিটি গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক দলের বিষয়ে কোনো স্বীকৃতি নেই। বিশেষ করে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তা নিয়েও খসড়ায় কিছু নেই। এটি হতাশার।

যদিও কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা সমাপ্ত হবে। সংলাপে যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাবে, সেগুলো নিয়ে ‘জুলাই সনদ’ বা ‘জাতীয় সনদ’ চূড়ান্ত করা হবে। তবে জাতীয় সনদের যে প্রাথমিক খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোকে মতামত দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে, তা নিয়ে সংলাপে আলাদা করে আলোচনা হবে না। বরং মতামত পাওয়ার পর তা সন্নিবেশিত করে চূড়ান্ত করা হবে সনদ। জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের জন্য সংলাপে একটি দিন বরাদ্দ করা হবে।

গত সোমবার দলগুলোর কাছে পাঠানো খসড়া জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ৭ দফা অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি দেশের শাসনব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচার, নির্বাচন, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বিষয়ে বেশকিছু প্রস্তাব রয়েছে, যা সনদ গৃহীত হওয়ার পর নির্বাচিত সরকার দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। এ ছাড়া খসড়ায় চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সংবিধানে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিতে অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে।

জানা যায়, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রকাশিত জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। অনেকে এ সনদকে একতরফা আখ্যায়িত করেছেন। তাদের অভিযোগ, এতে শুধু জুলাই আন্দোলনকে উচ্চকিত করা হয়েছে। কিন্তু বিগত দেড় দশকে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অসামান্য অবদান নিয়ে কিছু নেই। শুধু তাই নয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবজনক অধ্যায়কেও সেভাবে তুলে ধরা হয়নি। সনদ বাস্তবায়নে দুই বছরের সময়সীমা নিয়েও অনেকের অসন্তুষ্টির কথা জানান। তারা মনে করেন, আন্তরিকতা থাকলে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই তা (সনদ) বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

দলগুলোর মিশ্র প্রতিক্রিয়া: বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ গতকাল কালবেলাকে বলেন, জুলাই সনদের খসড়া পেয়েছি। তবে আরও পর্যবেক্ষণ করে আগামী ৩১ জুলাইয়ের পর এ নিয়ে মন্তব্য করব।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, এটি ‘অসম্পূর্ণ’ এবং কিছু অংশ ‘বিপজ্জনক’। আজকে তারা বলছে, এটা একটা নমুনা মাত্র, ভুল হয়েছে। যদি সেটাই হয়, তাহলে মন্তব্যের দরকার নেই। তবে যদি সেটাই মূল কথা হয়, তাহলে একে গ্রহণ করা যাবে না। জামায়াত নিজস্ব একটি খসড়া সনদ তৈরি করছে এবং কমিশনে জমা দেবে।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান বলেন, জুলাই সনদের খসড়ায় অনেক কিছুই অস্পষ্ট। যেমন- সেখানে বিগত দিনে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন ও সংগ্রাম নিয়ে কিছু উল্লেখ নেই। সেগুলো থাকলে আরও ভালো হতো। জুলাই আন্দোলনের জ্বলন্ত সব প্রমাণ থাকলেও এর বাস্তবায়নে দুই বছর সময় নেওয়া কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত নয়।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ছয়টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতির কথা বললেও তা নিয়ে আলোচনা ছাড়াই হঠাৎ করে জুলাই সনদের খসড়া প্রকাশ করেছে, যা সঠিক কাজ নয়। আমরা এটির তীব্র বিরোধিতা করছি। আলোচনার পদ্ধতি নিয়েই আলোচনা হয়নি, অথচ তারা খসড়া প্রকাশ করেছে। এটা আমরা গ্রহণ করতে পারি না।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, জুলাই সনদে যেসব বিষয়ে একমত হওয়া যাবে- আন্তরিকতা থাকলে সেগুলো সংসদের প্রথম অধিবেশনেই পাস করা সম্ভব। এ নিয়ে কেউ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে জনগণ মেনে নেবে না। ডকট্রিন অব নেসেসিটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে কীভাবে দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়, সেটি বিবেচনায় রাখতে হবে। তাহলে মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে।

বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (বিএলডিপি) চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন সেলিম কালবেলাকে বলেন, আমরা জুলাইকে যেমন ধারণ করি, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও লালন করি। কিন্তু জুলাই সনদের খসড়ায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সেখানে শুধু জুলাইকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অথচ জুলাইয়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। তাদের ত্যাগের কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। খসড়ায় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়ের স্বীকৃতি থাকলে পরিপূর্ণ গ্রহণযোগ্য হতো।

গণঅধিকার পরিষদের সিনিয়র সহসভাপতি ও মুখপাত্র ফারুক হাসান বলেন, জুলাই সনদে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো কথা নেই। শুধু জুলাইকে উচ্চকিত করা হয়েছে। সেখানে শুধু জুলাই শহীদ ও যোদ্ধাদের মহিমান্বিত করা হয়েছে। কিন্তু আমরা মনে করি, মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় জুলাই এসেছে। এটিও আমাদের গৌরবের।

জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) মহাসচিব মোমিনুল আমিন বলেন, জুলাই সনদ একটা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। তবে খসড়ায় চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ভূমিকা স্থান পায়নি। তবে সনদের অপূর্ণতা নিয়ে নিজেদের দলীয় অভিমত ঐকমত্য কমিশনের দৃষ্টিতে আনবেন বলে জানান।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদ কোনো দলের চিন্তার অনুলিপি হলে ছাত্র-জনতা মেনে নেবে না। কাউকে ক্ষমতায় বসানো কিংবা ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য জুলাই হয়নি। প্রয়োজনে আবার জুলাই ফিরে আসবে। কিন্তু কোনো দল বা গোষ্ঠীর তাঁবেদারি মেনে নেওয়া হবে না।’

জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ স্বার্থের দ্বন্দ্ব বলে মনে করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মো. সাহাবুল হক। তিনি কালবেলাকে বলেন, জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতদ্বৈধ পরিলক্ষিত হচ্ছে, এটি অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু নয়। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে কিংবা কিছুদিনের মধ্যে জুলাই সনদ ঘোষণা হওয়ার দরকার ছিল, সেটি হয়নি। জাতি হিসেবে আমাদের এটি সম্মিলিত ব্যর্থতা। এ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখন যেটি শুরু হয়েছে, সেটি হলো স্বার্থের দ্বন্দ্ব। সবাই যে যার জায়গা থেকে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের ক্রেডিট নিতে চাচ্ছে। এটি আবার তারা জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্তও করতে চাচ্ছে। দিন যত যাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হবে। ঐকমত্য কমিশনের উচিত শুধু রাজনৈতিক দল নয়, জুলাই অভ্যুত্থানের সব অংশীদারকে নিয়ে বসে অতি দ্রুত জুলাই সনদ ঘোষণা করা। তা না হলে জুলাই সনদ ঘোষণা আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com