ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তৎপরতা বেড়েছে। সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর নির্বাচনী ট্রেনের গতি বেড়েছে। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে। মাঠ প্রশাসন প্রস্তুত করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে; প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল করা হচ্ছে। জানা গেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বর্ষপূর্তির মধ্যেই ভোটানুষ্ঠানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বার্তা দেওয়া হবে সরকারের তরফে। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠান নির্বাচন আয়োজন করবে, সেই নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে এ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো বার্তা দেয়নি সরকার। তবে নিজেদের তাগিদেই প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি।
নির্বাচন নিয়ে সরকার তার মতো করে প্রস্তুতি নেবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে ইসিকে ভোটের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হলে তাদের কাজে শৃঙ্খলা ও গতি বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সরকারের চাহিদার সঙ্গে ইসির পরামর্শের যোগফলে একটি সুষ্ঠু ও বিতর্কহীন নির্বাচন হতে পারে, বলছেন তারা।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভোট করতে হলে ইসির হাতে আছে পাঁচ মাস। এ সময়ের মধ্যে সব কাজ সম্পন্ন করে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে নির্বাচনী তারিখ ঘোষণা করবে ইসি। এর ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন। তিনি বলেছেন, ভোট যখনই হোক, দুই মাস আগে তফসিল জানিয়ে দেওয়া হবে।
জানা গেছে, সরকার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনকে ভোটের দিনক্ষণ জানালে তফসিলের প্রস্তুতি নেবে ইসি। সেক্ষেত্রে তফসিলের আগে এবং তফসিল ঘোষনার পর কি কি করা দরকার, এসব নিয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা সাজাবে ইসি। যদিও ইসির প্রস্তুতি ডিসেম্বরকে টার্গেট করে। এ জন্য রুটিন কাজ অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছে কমিশন। ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, ভোটের সরঞ্জাম কেনাকাটা, ভোটকেন্দ্র প্রস্তুত করা, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের রদবদল, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে ইসি।
আগামী নির্বাচনের জন্য কর্মকর্তাদের প্রস্তুত করতে প্রয়োজনীয় কাজ হাতে নিয়েছে ইসি। এক্ষেত্রে বিগত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে যেসব কর্মকর্তা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছেন, আগামী নির্বাচনে তাদের দায়িত্ব না দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি।
নির্বাচন ঘিরে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক প্রস্তুতিসংক্রান্ত উচ্চপর্যায়ের বৈঠক গত সোমবার অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে। সেই বৈঠকের পর জানানো হয়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সরকার ব্যাপক নিরাপত্তা প্রস্তুতি এবং সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় জোরদারে কাজ শুরু করেছে। আগামী সেপ্টেম্বর থেকে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে নির্বাচনবিষয়ক বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ কার্যক্রম চলবে অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত। এবারের নির্বাচনের সময় ৬০ হাজার সেনাসদস্য মোতায়েন থাকার বিষয়টিও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বিগত নির্বাচনগুলোতে সাধারণত দেখা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ইসি তাদের প্রস্তুতি সরকারকে অবগত করত। আর সরকারের পক্ষ থেকে সুবিধামতো সময়ের পরামর্শ দেওয়া হতো। সেই সময়ের মধ্যে ইসি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করত। এবার যেহেতু বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাই অনেক কিছুতেই ব্যত্যয় হওয়াটা স্বাভাবিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
জানা গেছে, নির্বাচন কমিশন সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে। আগামী ৮ আগস্টের মধ্যে (অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তি) যদি সরকার থেকে বলা হয়- অমুক মাসে ভোট, তা হলে সেই সিদ্ধান্ত ধরে ইসি পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা সাজাবে। বিস্তারিত তফসিল দেবে। এর আগে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করে তাদের পরামর্শ নেবে ইসি। পাশাপািশ বিশ্লেষকদের সঙ্গেও বৈঠক করতে পারে।
ইসির প্রস্তুতির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা বিষয়টা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দেখবে। আমরা যতটুকু বুঝতে পারছি, তারা তৎপর (সিরিয়াস)। তারা মিটিং করছেন, পত্রপত্রিকায় দেখছি। তারা তাদের লাইনে কাজ আগাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো করে যাচ্ছি। (আগামী পাঁচ মাসের মধ্যে ) ধরে নিন আমরা প্রস্তুত।
আইন, বিধিমালা, নীতিমালাগুলো হয়ে আছে। নির্বাচনী মূল আইন আরপিও সংস্কার প্রস্তাব প্রায় চূড়ান্ত। কোনোটাই যেন সংবিধান, আইন কিংবা পরস্পরের সাংঘর্ষিক না হয়, সে বিষয়গুলো দেখা হচ্ছে।
নির্বাচন বিশ্লেষক ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আব্দুল আলীম বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে বার্তা হচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে। সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইসিকে বিষয়টি অবগত করলে ভালো হতো, একটা সমন্বয় থাকত। এবারের নির্বাচনের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা। এ জন্য ইসির নিজস্ব মনিটরিং দক্ষতা থাকতে হবে। তাই আগে থেকে ইসিকে জানালে বেশি ভালো হয়।
রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, বিশ্লেষকই শুধু নয়, দেশের মানুষও মনে করে যে, নির্বাচনকালীন সরকার আর নির্বাচন কমিশনের মধ্যে সমন্বয় থাকলে একটি ভালো নির্বাচন হতে পারে। ভোটের আগেই সরকারের সঙ্গে সমন্বয় না হলে এর প্রভাব ভোটে পড়তে পারে- এমন শঙ্কার কথাও জানিয়েছেন অনেকে। তারা মনে করেন সরকার ভেতর থেকে যেহেতু একটা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, সেই পরিকল্পনাটা ইসিকেও জানানো উচিত।