সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুরের উতলারপাড় এলাকায় এক বিস্ময়কর ঘটনা দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। সেখানে একটি টিলা থেকে নির্বিচারে গ্যাস বের হচ্ছে, যা আগুনের সংস্পর্শে এলেই জ্বলে ওঠে। রাত-দিন আগুন জ্বলতে থাকায় দূর থেকে মনে হয় যেন আগুনের পাহাড়। এর পাশের পুকুর থেকেও গ্যাস নির্গত হচ্ছে এবং পানিতে দিয়াশলাই ধরিয়ে দিলেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে।
সাম্প্রতিক সময়ে উতলারপাড় এলাকার পোড়া টিলায় নতুন করে ফাটল দেখা দিয়েছে। সেই ফাটল দিয়ে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস ছড়িয়ে পড়ছে, যা আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে। স্থানীয়রা জানান, সন্ধ্যার পর টিলার বিভিন্ন জায়গায় আগুনের শিখা জ্বলে ওঠে, যা রাতে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বিস্ফোরণের ইতিহাস: স্থানীয়দের মতে, ১৯৫৫ সালে এখানে দেশের প্রথম গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেড (পিপিএল) গ্যাস উত্তোলনের জন্য খননকাজ শুরু করেছিল, কিন্তু গ্যাসের অতিরিক্ত উচ্চচাপের কারণে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের তীব্রতায় অনুসন্ধান কাজে ব্যবহৃত সব যন্ত্রপাতি মাটির নিচে তলিয়ে যায় এবং ভূমিধসে সেখানে একটি পুকুরের সৃষ্টি হয়। সেই থেকেই পুকুরের পানিতে সর্বদা বুদবুদ দেখা যায় এবং আগুন ধরালে তাতে আগুন লেগে যায়।
স্থানীয় প্রবীণদের মুখে শোনা যায় ভিন্ন এক কাহিনি। তারা দাবি করেন, ওই এলাকায় এক পীর শাহ আহমদ আলী ছিলেন, যিনি পুকুর খননের ব্যাপারে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তার নিষেধ অমান্য করেই গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যার ফলে এ বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের পর কয়েকদিন ধরে পুরো এলাকা জ্বলতে থাকে, যা নিয়ন্ত্রণে আনতে শেষ পর্যন্ত সেই পীরের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
পর্যটকদের আকর্ষণ: এই বিস্ময়কর প্রাকৃতিক ঘটনা দেখতে প্রতিদিন শত শত পর্যটক উতলারপাড়ে ভিড় করছেন। বিশেষ করে শুক্র ও শনিবার পর্যটকদের ঢল নামে। কেউ আগুনের দৃশ্য উপভোগ করেন, আবার কেউ পানিতে দিয়াশলাই দিয়ে আগুন ধরানোর চেষ্টা করেন। অনেকে গ্যাসের ফাটল থেকে আগুন জ্বেলে দেখে আনন্দ পান। কিন্তু এই পুরো এলাকা কোনো ধরনের নিরাপত্তাবেষ্টনী ছাড়াই উন্মুক্ত রয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, এলাকাটিতে পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেই। প্রায় ২০ বছর আগে হরিপুর গ্যাস ফিল্ড কর্তৃপক্ষ একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করেছিল, যা এখন বিলীন হয়ে গেছে। যদিও গ্যাস ফিল্ড কর্তৃপক্ষ ‘বিপজ্জনক এলাকা’ চিহ্নিত করে কিছু নোটিশ ঝুলিয়ে রেখেছে, তবে পর্যটকরা তা আমলে নিচ্ছেন না।
ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা পর্যটক বরুণ রায় বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এখানে গ্যাস বের হচ্ছে, যা সরকারের জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ। এই গ্যাসের যথাযথ ব্যবস্থাপনা করলে দেশে গ্যাসের সংকট অনেকটা দূর হতে পারত।’
কিশোরগঞ্জ সরকারি কলেজের দুই শিক্ষার্থী স্বর্ণা ও স্বপ্না বলেন, ‘এটি একটি অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। কিন্তু এখানে কোনো নিরাপত্তা নেই। যদি বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে ভয়াবহ হতে পারে।’
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতামত ও আতঙ্ক: স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল খালিক দুলাল বলেন, ‘এখানে একজন বড় পীর ছিলেন, যিনি গ্যাস উত্তোলন নিষেধ করেছিলেন; কিন্তু নিষেধ না মেনে খনন করায় এ বিপর্যয় ঘটে। এরপর থেকে এই পুকুর ও টিলায় গ্যাস নির্গত হচ্ছে।’
অন্যদিকে, কিশোর সাকিব আহমদ, সে বিকেলে এই টিলায় পর্যটকদের আগুন ধরিয়ে দেখিয়ে বকশিশ পায়, সে জানায়, ‘শুক্র ও শনিবার প্রচুর মানুষ আসে। তারা আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করে, আমি তাদের সাহায্য করি। এতে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হয়।’
তবে, স্থানীয় অনেকেই গ্যাসের এ অনিয়ন্ত্রিত নির্গমন ও পর্যটকদের অনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপ নিয়ে শঙ্কিত। বেশ কয়েকটি স্থানে নতুন করে ফাটল দেখা দেওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, যে কোনো সময় বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
কর্তৃপক্ষ যা বলছে: সিলেট গ্যাস ফিল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. আব্দুল জলিল প্রামাণিক এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি ফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান এবং পরে কথা বলবেন বলে লাইন কেটে দেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘হরিপুরের গ্যাস নির্গমণ বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে জায়গাটি সংরক্ষণ করা দরকার, অন্তত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপদ করা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটি পর্যটকদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। আমি সরেজমিন এলাকা পরিদর্শন করব এবং সম্ভাব্য ঝুঁকি নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নতুন সম্ভাবনা: অনেক পর্যটক ও বিশেষজ্ঞের মতে, যদি সরকার উদ্যোগ নেয়, তাহলে এই গ্যাস নির্গমণের স্থানকে একটি নিরাপদ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। সঠিকভাবে গ্যাস উত্তোলন করা হলে এটি দেশের জন্যও লাভজনক হতে পারে।
সুনামগঞ্জ থেকে আসা পর্যটক তানিয়া পারভীন বলেন, ‘আমরা এ জায়গাটি দেখার জন্য অনেক আগ্রহী ছিলাম। এটি সত্যিই দারুণ একটি স্থান, তবে কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।’
রাজীবাড়ি থেকে আসা জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সরকার যদি এখানে সিকিউরিটি ও পর্যটন সুবিধা নিশ্চিত করে, তাহলে এটি দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে।’
সিলেটের উতলারপাড়ে ৭০ বছর ধরে চলা এই প্রাকৃতিক বিস্ময় একদিকে যেমন পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু, অন্যদিকে স্থানীয়দের আতঙ্কের কারণ। একদিকে, এটি দেশের প্রথম গ্যাস ক্ষেত্রের এক রহস্যময় স্মৃতি, অন্যদিকে এর অনিয়ন্ত্রিত নির্গমন জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। সরকার যদি এ এলাকা সংরক্ষণ এবং পর্যটন সুবিধা উন্নত করার উদ্যোগ নেয়, তাহলে এটি বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় ও নিরাপদ পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। এখন দেখার বিষয়, কতদিনের মধ্যে সরকার এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়।