মহান আল্লাহ নিজ প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আমাদের দিয়েছেন অনেক দায়িত্ব। পৃথিবীর সব অগ্রগতি মহান আল্লাহর ইচ্ছায় আমাদের পরিশ্রমের ফলে হয়ে থাকে। আমাদের জীবন পরিশ্রমের এক পরম প্রতিচ্ছবি। কেউ মস্তিষ্কের পরিশ্রমে ব্যস্ত, আবার কেউ শারীরিক শ্রমে। এই পরিশ্রম আমাদের মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্লান্ত করে তোলে। দিন-রাতে কাজের ক্লান্তিতে আমরা মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়ি। ক্লান্তির পর পুনরায় কর্মক্ষম হতে আমাদের কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন হয়। তাই মহান আল্লাহ আমাদের জন্য ঘুমের মতো এক বড় নিয়ামত দান করেছেন। ঘুমের মাধ্যমে আমাদের শরীর ক্লান্তিমুক্ত হয়। আমরা পরের দিন নতুন করে কাজ করার শক্তি সঞ্চয় করি। যদি কেউ পর্যাপ্ত না ঘুমায়, কম ঘুমায় বা শান্তিময় ঘুমের অভাব থাকে, তাহলে সে দ্রুত মানসিক ও শারীরিক রোগের শিকার হয়। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) তাকে বলেন, হে আবদুল্লাহ! আমাকে কি এ খবর দেওয়া হয়নি যে, তুমি রাতভর ইবাদতে দাঁড়িয়ে থাকো এবং দিনভর রোজা রাখো? আমি বললাম, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বললেন, তুমি এরূপ করো না। বরং রোজা রাখো, আবার রোজা রাখা বিরতও দাও, রাত জেগে ইবাদত করো এবং নিদ্রাও যাও। তোমার শরীরেরও তোমার ওপর হক আছে; তোমার চোখেরও তোমার ওপর হক আছে এবং তোমার স্ত্রীরও তোমার ওপর হক আছে। (সহিহ বুখারি ৫১৯৯) শান্তিপূর্ণ ও আরামদায়ক ঘুমের জন্য শোয়ার আগে কিছু প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন। বিশদভাবে তা উল্লেখ করা হলো।
রাতের খাবারের সময় : ঘুমানোর অন্তত তিন ঘণ্টা আগে রাতের খাবার খাওয়া উচিত। কারণ খাওয়ার পরপরই পাকস্থলী হজমের প্রক্রিয়া শুরু করে, যা অনেক শ্রমসাধ্য। হজমে সহায়তা করার জন্য মস্তিষ্ক রক্তপ্রবাহকে পাকস্থলীর দিকে কেন্দ্রীভূত রাখে। এতে শরীর ঘুমের জন্য প্রস্তুত হয় না। যদি ঘুম আসেও, পাকস্থলীর ভার আপনার পুরো পরিপাকতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে।
অতিরিক্ত আলো বন্ধ করুন : শরীর ও মন তখনই ঘুমের জন্য প্রস্তুত হয়, যখন চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। তাই ঘুমানোর অন্তত আধা ঘণ্টা আগে বাড়ির অপ্রয়োজনীয় বাতি নিভিয়ে ফেলুন। ঘুমের আগে সব প্রস্তুতির কাজ যেমন : বাথরুমে যাওয়া, দাঁত ব্রাশ করা কিংবা অজু করা, হাল্কা আলোতে করুন। এতে আপনার শরীর শোয়ার আগেই ঘুমের জন্য প্রস্তুত হবে এবং শয়ন করলেই ঘুম আসবে।
ইলেকট্রনিক ডিভাইস বন্ধ করুন : ঘুমানোর অন্তত দেড় ঘণ্টা আগে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ করা উচিত। এই ডিভাইসগুলো এক ধরনের তীব্র নীল আলো নির্গত করে, যা শরীরে মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণ বাধাগ্রস্ত করে। এতে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। তাই সন্ধ্যার পর ঘরের আলোর উৎস, বিশেষ করে শয়ন কক্ষের আলো কমিয়ে রাখা উচিত।
বিছানা ঝেড়ে নিন : ঘুমানোর আগে বিছানা অবশ্যই ভালোভাবে ঝেড়ে নিন এবং সকালে উঠে বিছানা গুটিয়ে রাখুন। অনেক সময় দেখা যায়, দিনের বেলায় বিষাক্ত পোকামাকড় বিছানায় লুকিয়ে থাকে। রাতে কেউ বিছানায় গেলে সেই পোকা তাকে কামড়ে দেয়, যা মারাত্মক বিপদের কারণ হতে পারে। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন বিছানায় যাবে, তখন সে যেন তার কাপড়ের কিনারা (ঝাড়–) দিয়ে বিছানাটি তিনবার ঝেড়ে নেয়। (সহিহ বুখারি ৭৩৯৩) আরেকটি বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে, বিছানায় কোনো খাবার বা খাবারের কণা না আনা। কারণ খাবারের কণা বিছানায় পড়লে তাতে পোকামাকড় আকৃষ্ট হতে পারে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অর্জন করা : দিনভর মানুষ নানা জিনিস স্পর্শ করে, যা থেকে শরীরে বিভিন্ন রকমের জীবাণু জমা হয়। তাই ঘুমানোর আগে পবিত্রতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। বাথরুমে যাওয়া, দাঁত ব্রাশ বা মিসওয়াক করা এবং অজু করে নেওয়া উচিত। বিশেষ করে ঘুমানোর আগে মূত্রত্যাগ করা প্রয়োজন। কারণ মূত্রথলি পূর্ণ থাকলে ঘুম আরামদায়ক হয় না। চিকিৎসকরা বলেন, দাঁতের ক্ষতিকর পদার্থ (প্লাক) সবচেয়ে বেশি রাতে জমে। তাই ঘুমানোর আগে ভালোভাবে দাঁত ব্রাশ বা মিসওয়াক এবং অজু করলে দাঁত পরিষ্কার থাকবে এবং শরীর জীবাণুমুক্ত থাকবে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন তুমি বিছানায় যাবে, তখন নামাজের অজুর মতো অজু করে ডান কাত হয়ে শয়ন করবে। (সহিহ বুখারি ২৪৭) এতে শরীর যেমন পরিষ্কার থাকবে এবং অনেক রোগবালাই থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
ঘুমানোর স্থান : শান্তিতে ঘুমের জন্য ঘুমানোর স্থানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘুমানোর স্থানটি নিরাপদ এবং বাতাস চলাচলের উপযোগী হওয়া উচিত। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি এমন ছাদের ওপর ঘুমায় যেখানে কোনো বেষ্টনী বা আড়াল নেই, তার থেকে (আল্লাহর) জিম্মাদারি ওঠে যায়। (আবু দাউদ ৫০৪১)
আরামদায়ক ঘুমের জন্য ঘুমানোর স্থান ও বিছানা আরামদায়ক হওয়া জরুরি। আর ঘরের ঘুমানোর জায়গাটি অন্য যেকোনো জায়গার তুলনায় বেশি আরামদায়ক হয়ে থাকে। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মেঝেতে নয়, বরং কিছুটা উঁচু স্থানে ঘুমানোর জন্য বিছানা ব্যবহার করে আসছে। এটি ধীরে ধীরে খাট ও আধুনিক বেডের রূপ নিয়েছে। হাদিসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, রাসুল (সা.) নিজেও বিছানায় ঘুমাতেন।
বিছানা নরম হওয়া উচিত নাকি শক্ত? এটি মানুষের আরামদায়ক ঘুমের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তাই বিছানা এমন হওয়া উচিত, যা অতিরিক্ত নরম না হয়, যাতে শরীর তাতে ডুবে যায়, কিংবা অতিরিক্ত শক্ত না হয়, যাতে শরীর আরাম অনুভব না করে। একই সঙ্গে বিছানা অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া উচিত। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.)-এর বিছানা ছিল চামড়ার, যার ভেতর খেজুরের ছাল ভরা থাকত। (সহিহ ইবনে হিব্বান ৬৩৬১)
মাটিতে সোজা বা শক্ত বিছানায় ঘুমানোর ফলে পিঠের ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, কারণ নরম গদি শরীরকে পুরোপুরি সাপোর্ট দিতে পারে না। ঘুমানোর সময় শরীর তাতে ডুবে যায়, ফলে পিঠে বাঁক সৃষ্টি হয় এবং পিঠ ও মেরুদণ্ডের পেশিগুলো দুর্বল হয়ে যায়। দীর্ঘদিন নরম বিছানা ব্যবহারের ফলে এই ব্যথা আরও বেড়ে যায়। গবেষকদের মতে, নরম বিছানা কিডনির ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং এমনকি কিডনির নালিতে জটিল প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে। এ জন্য আধুনিক বিশেষজ্ঞরা নরম বিছানা পরিত্যাগের পরামর্শ দেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পিঠে ব্যথার ক্ষেত্রে গদির নিচে শক্ত প্লাইউড রাখা উচিত অথবা গদি মাটিতে বিছিয়ে তাতে শোয়া উচিত। শক্ত গদি ব্যবহার করলে মেরুদণ্ডের কর্মক্ষমতা বাড়ে এবং শরীরে রক্ত সঞ্চালন উন্নত হয়। ফলে ঘাড় ও কাঁধের ব্যথা থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়।
প্রতিটি মানুষকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। প্রতিদিন ইবাদত-বন্দেগি করতে হয়। করতে হয় আরও নানা কাজ। এসব কাজের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর ঘুম। ঘুমের জন্য মহান আল্লাহ রাতকে নির্ধারণ করেছেন। রাতের পরিবেশ থাকে নিবিড়। আর ঘুমের জন্য নিবিড় পরিবেশের বিকল্প নেই। তাই আমাদের উচিত রাতের প্রথমাংশেই যাবতীয় কাজ সেরে ফেলা এবং খুব দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া। অতঃপর ফজরের আগে ঘুম থেকে ওঠে মহান আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত হওয়া। পারলে আরও আগে ওঠে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা। মহান আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে তাহাজ্জুদের নামাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর ফজরের নামাজের পর অবশ্যই ভোরের আবহাওয়ায় একটু হাঁটাহাঁটি করা, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। মহান আল্লাহ আমাদের এভাবে জীবনযাপন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।