মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের একটি মামলায় ছয় মাস আগে গ্রেপ্তারের হন মনিকা বেগম (ছদ্মনাম)। তখন তার কোলে ছিল মাত্র তিন মাস বয়সী একটি শিশু। গ্রেপ্তারের পর থেকে শিশুটি মায়ের সঙ্গে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের পরিবেশে বড় হচ্ছে।
এখন তার বয়স নয় মাস। শুধু এই একটি শিশু নয়, চট্টগ্রাম বিভাগের ১০টি কারাগারে বর্তমানে মায়েদের সঙ্গে বন্দি অবস্থায় রয়েছে মোট ৭৮ শিশু।
এদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ স্বাভাবিক নয়, ফলে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
কারাবিধি অনুযায়ী, ছয় বছরের কম বয়সী শিশুদের মায়ের সঙ্গে কারাগারে থাকার সুযোগ রয়েছে। সেই নিয়মে বন্দি মায়েদের সন্তানদের শৈশবও কাটছে কারাগারের চার দেয়ালের মাঝে। কারা কর্মকর্তাদের মতে, এসব শিশু মায়েদের জন্য নির্ধারিত নারী ওয়ার্ডেই ঘুমায় এবং কিছু সময় খেলাধুলার সুযোগ পায়। অসুস্থ হলে প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাও রাখে কারা কর্তৃপক্ষ। এভাবেই দিন কাটছে শিশুগুলোর।
মানবাধিকার কর্মীদের উদ্বেগ: বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, তৈরি হয় দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ
মানবাধিকার কর্মীরা মনে করছেন, কারাগারে বেড়ে ওঠা শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ গুরুতরভাবে ব্যাহত হয়।
তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী—
বৈরী পরিবেশের স্মৃতি শিশুর মস্তিষ্কে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে
বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় সামাজিকীকরণ ব্যাহত হয়
খেলার মাঠ, সহপাঠী বা স্বাভাবিক পরিবেশের সুযোগ না থাকায় মানসিক প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়
নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ শিশুদের মাঝে ভয়, উদ্বেগ ও মানসিক চাপ বাড়ায়
যথাযথ পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষামূলক সুযোগের অভাব শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে
এছাড়া কারাগার থেকে বের হওয়ার পর এসব শিশু সমাজে খাপ খাওয়াতে অনেকসময় সমস্যায় পড়ে।
মানবাধিকার সংগঠনের এক কর্মকর্তা বলেন, দুগ্ধপোষ্য শিশুদের রাখার জন্য দেশে আলাদা কোনো সুরক্ষিত ব্যবস্থা না থাকায় মায়ের সঙ্গে কারাগারে থাকতে হয়। শিশুর কোনো অপরাধ না থাকলেও তাকে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর বন্দি পরিবেশে বেড়ে উঠতে হচ্ছে—যা মানবাধিকার লঙ্ঘন। সরকারের নতুন উদ্যোগ না নিলে এই সংকট কাটানো সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন।
চট্টগ্রাম বিভাগের কারাগারগুলোর পরিস্থিতি
চট্টগ্রাম বিভাগে মোট ১১টি কারাগার রয়েছে। এর মধ্যে ১০টিতে বন্দি মায়েদের সঙ্গে রয়েছে ৭৮ শিশু। সংখ্যাগুলো হলো
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার: ২২
কক্সবাজার জেলা কারাগার: ২৬
খাগড়াছড়ি জেলা কারাগার: ২
রাঙামাটি জেলা কারাগার: ১
বান্দরবান জেলা কারাগার: ১
কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার: ৮
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারাগার: ৮
চাঁদপুর জেলা কারাগার: ২
নোয়াখালী জেলা কারাগার: ১
লক্ষ্মীপুর জেলা কারাগার: ৩
ফেনী কারাগার: ৪
ছেলে শিশু ৪১ জন এবং মেয়ে শিশু ৩৭ জন।
কারা প্রশাসনের ব্যাখ্যা: নিয়ম মেনেই মায়েদের সঙ্গে রাখা হয়
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কর্মকর্তা জানান, আদালতের নির্দেশে দুগ্ধপোষ্য শিশুদের মায়েদের সঙ্গে রাখা হয়। নিয়ম অনুযায়ী শূন্য থেকে ছয় বছরের কম বয়সী শিশুরা মায়ের সঙ্গে থাকতে পারে। বয়স ছয় বছর হলে তাদের স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন
শিশুদের জন্য আলাদা খেলনার ব্যবস্থা আছে
তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়
প্রয়োজন হলে স্বাস্থ্যসেবাও দেওয়া হয়
চট্টগ্রাম বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শকের মতে, শিশুদের জন্য নতুন পোশাক, খেলনা এবং যতটা সম্ভব খেলাধুলার সুযোগ দেওয়া হয়। তাদের নিরাপদ রাখতে সবসময় নজরদারিও থাকে।
চট্টগ্রাম বিভাগের কারাগারগুলোতে মায়েদের সঙ্গে বেড়ে ওঠা শিশুদের সংখ্যা কম নয়। যদিও কারাবিধি কিছু সুযোগ দিয়েছে, তবুও কারাগারের সীমাবদ্ধ পরিবেশ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধার সৃষ্টি করছে। মানবাধিকারকর্মীরা এ পরিস্থিতিকে অমানবিক বলে মন্তব্য করছেন। উন্নত পরিবেশ, বিশেষ কেন্দ্র বা পৃথক ব্যবস্থার মাধ্যমে শিশুদের অধিকার রক্ষায় সরকারি উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।