ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পটুয়াখালীর এক শিক্ষার্থী। তার প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি এলাকায় জানিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন তারই এক আত্মীয়। একই জেলার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মাসুদ রানার কাছে ওই প্রার্থীর পক্ষে চেয়েছেন ভোট। নিজের পরিচয় দিয়েছেন ওই প্রার্থীর আত্মীয় হিসেবে। শুধু প্রার্থীর ওই আত্মীয় একাই নন, এলাকার আরও কয়েকজন মাসুদের মোবাইল ফোনে কল করে এলাকার শিক্ষার্থীকে ভোট দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
মাসুদ রানার বাড়িও পটুয়াখালী জেলায়। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘এলাকা থেকে অনেকেই ফোন দিয়ে ভোট চাচ্ছেন। আমার এলাকার এক ছোট ভাই এবারের ডাকসু নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে তা জানতাম না, কিন্তু ওই ছোট ভাইয়ের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে আমাকে এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমি তার আত্মীয়। তাকে একটা ভোট দিয়েন’।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী আশিকুর রহমান। তিনি এবার ডাকসুর মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনবিষয়ক সম্পাদক পদপ্রার্থী। বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে। আশিকুর জানান, কয়েকদিন আগে তার গ্রামের এক ব্যক্তি শিবির সমর্থিত প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’-এর সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী সাদিক কায়েমের পক্ষে ভোট চান। তিনি বলেন, ‘ওই ব্যক্তির সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক হওয়ায় মাঝে মাঝে তার সঙ্গে কথা হয়। তিনি একদিন ফোন দিয়ে সাদিক ভাইকে ভোট দেওয়ার অনুরোধ জানান।’
এভাবেই ডাকসু নির্বাচনের উত্তাপ ঢাবি ক্যাম্পাস পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্রত্যন্ত জনপদেও।
জেলা-উপজেলা শহর থেকে গ্রামাঞ্চল—সবখানেই চলছে ডাকসু নির্বাচনের আলোচনা। চায়ের কাপে চুমুকে চলছে ডাকসু নিয়ে বিতর্ক। এবারের নির্বাচনে কে হবেন ভিপি, জিএস কিংবা এজিএস তা নিয়ে আড্ডায় মাতছেন অনেকেই।
বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থী এবং রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা নিজ নিজ পছন্দের বা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে চালাচ্ছেন প্রচার, ভোট চাইছেন বন্ধু-পরিচিতদের কাছে। প্রার্থীরাও থেমে নেই, দেশের নানা প্রান্তে থাকা সহপাঠীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে সমর্থন আদায়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকাকেন্দ্রিক বিভিন্ন জেলা, উপজেলা সমিতির পক্ষ থেকেও নিজ নিজ এলাকা ও সংগঠনে সম্পৃক্ত প্রার্থীদের পক্ষে প্রচার ও ভোট চাওয়া হচ্ছে।
ছাত্র সংগঠনের নেতারাও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এলাকার নেতাদের কাছে এ কাজে সহযোগিতা প্রত্যাশা করছেন। বিশেষ করে এক্ষেত্রে এগিয়ে ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবির। তাদের স্থানীয় ছাত্রনেতাদের মাধ্যমে ঢাবিয়ানদের বাসায় গিয়ে গিয়েও ভোট চাইছেন বলে জানা গেছে। ফেসবুকে পোস্ট দিয়েও স্থানীয় ও সাবেক নেতাদের সরাসরি ক্যাম্পেইন করতে দেখা গেছে। গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের প্যানেল ঘোষণার পর জাতীয় নাগরিক পার্টির একাধিক নেতা তাদের প্রার্থীদের সমর্থন জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট ও মন্তব্য করেছেন। যদিও অনেকেই এই প্যানেলের প্রার্থীদের মধ্যে আব্দুল কাদেরকে একমাত্র যোগ্য বলছেন। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া গ্রহণযোগ্যতা এবং ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয় এসব নেতার সমর্থন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ভোটসংখ্যাকে প্রভাবিত করতে পারে। এ ছাড়া ছাত্র অধিকার পরিষদ, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্ষেত্রেও একই রকম চিত্র দেখা গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের ডাকসু নির্বাচনে বড় প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এটিকে ব্যবহার করে প্রচার, ভোট চাওয়ার পাশাপাশি গুজব ও অপপ্রচারও অনেক বেশি দেখা যাবে। একদিকে যেমন নির্বাচনী আমেজ লক্ষ করা যাবে, অন্যদিকে নেতিবাচক অনেক বিষয়ও উঠে আসবে। আর ডাকসু নির্বাচনের সময় নিজেদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে এলাকাকেন্দ্রিক ভোট চাওয়ার রীতি অনেক পুরোনো। বিগত ডাকসু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এমনটি দেখা গেছে।
ঢাবির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সারজানা লিমানা বলেন, ‘একদিন সকালে ইসলামী ব্যাংকের, আমার এলাকা অর্থাৎ সীতাকুণ্ড ব্রাঞ্চের একজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা আমার বাসার ফোন থেকে ফোন দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেন। কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ‘সাদিক কায়েম-ফরহাদ প্যানেল দিয়েছে না, সম্ভবত নাম শুনেছ, তাদেরকে একটা ভোট দিও’।’
কক্সবাজার অঞ্চলের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান বলেন, ‘অন্তত পাঁচজন আমার কাছে তাদের সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়েছেন। তারা অনুরোধ করেছেন যেন কক্সবাজারের সেই প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জয়ী হতে সহযোগিতা করি। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই প্রচার চালাচ্ছেন। ছাত্রদল, শিবিরের এবং অন্যান্য প্রার্থীর পক্ষেও প্রচার ও ভোট চাওয়া হচ্ছে।’
ডাকসু নির্বাচনে নিজেদের প্যানেলকে জয়ী করতে শিবির তাদের পুরো সাংগঠনিক জনশক্তি কাজে লাগিয়েছে বলে উল্লেখ করেন ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ হিল বাকী। তিনি বলেন, ‘শিবির তার পুরো জনশক্তিকে অ্যাক্টিভ করেছে প্রচারে। শুধু ঢাবি নয়, ঢাবির বাইরেরও যারা লেখালেখি করে, অ্যাক্টিভিস্ট, সবাই ক্যাম্পেইন করছে শিবিরের প্যানেলের জন্য। এটা নির্বাচনের দিন পর্যন্ত চলতে থাকবে। ছাত্রদলও শেইম (একইরকম)। বিএনপির মূল ফেসবুক পেজ, মিডিয়া সেলের পেজে পর্যন্ত প্রচার চালানো হচ্ছে। বিএনপির বড় বড় নেতারা ছাত্রদলের প্যানেলের প্রতি সমর্থন চেয়ে পোস্ট করছেন।’
লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট সালমান সাকিবের মতে, ডাকসুর এবারের নির্বাচনে মূল লড়াইটা হবে শিবির এবং ছাত্রদলের মধ্যে। তিনি বলেন, ‘ডাকসুর ক্ষেত্রে ছাত্রদলের প্যানেল ঢাবিতে অধ্যয়নরত বিএনপি ফ্যামিলির (বিএনপি সমর্থক পরিবার হিসেবে পরিচিত) প্রত্যেকের সঙ্গে যোগাযোগ করবে নির্বাচন সামনে রেখে। কীভাবে এত বছর পরের ডাকসুতে নিজেদের প্যানেলকে জয়ী করা যায় সে লক্ষ্যে সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করছে ছাত্রদল। ছাত্রদলের মতো শিবিরও চেষ্টা করবে সারা দেশের সব জামায়াত ও শিবির ফ্যামিলির ঢাবিয়ানদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।’
তবে আঞ্চলিক এমন প্রচার শেষমেশ ভোটের হিসাবে তেমন একটা প্রভাব ফেলবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দিনশেষে এগুলো অনলাইনে হাইপ ওঠানো (উত্তেজনা ছড়ানো) ছাড়া কিছু না। ভোটের মাঠে শিক্ষিতদের কাছে গ্রহণযোগ্য বিষয় হয়ে উঠবে কোন সংগঠন শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে কতটুকু পজিটিভ (ইতিবাচক) ভূমিকা রাখতে পারবে তা। এ বিষয়টি নির্ধারণ করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোটাররা।’
ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট থেকে কার্যনির্বাহী সদস্য পদে নির্বাচন করা মিফতাহুল হোসাইন আল মারুফ কালবেলাকে বলেন, ‘দীর্ঘ সময় পরে ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে এই আমেজ সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের সমর্থকরা উচ্ছ্বাস থেকেই প্রচার চালাচ্ছেন। এটিকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি।’
বিষয়টি একইভাবে দেখছেন ছাত্রদলের প্যানেল থেকে জিএস পদে নির্বাচন করা তানভীর বারী হামিম। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘ডাকসু শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ নয়, এটির ব্যাপ্তি দেশব্যাপী। আমাদের পক্ষে সারা দেশে যে গণজোয়ার রয়েছে তারও একটি প্রমাণ। আমরা তাদের এই উচ্ছ্বাসকে সম্মান করি।’
আঞ্চলিক প্রচারকে ইতিবাচক বলছেন ছাত্র অধিকার পরিষদের ভিপি পদপ্রার্থী বিন ইয়ামীন মোল্লাও। তিনি বলেন, ‘একে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবসময় নেতৃত্বের আসনে থেকেছে, আর নেতৃত্ব চাইলে জোর করে দেওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর গ্রহণযোগ্যতা—এসব চাইলেও গড়ে তোলা যায় না। আমার বিশ্বাস, এ ধরনের গণতান্ত্রিক চর্চা ও
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিমূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরও উজ্জ্বলভাবে সামনে আসবে এবং এর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দেশের মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে যাবে।’
ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে এলাকাকেন্দ্রিক প্রচারকে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবেই দেখছেন ডাকসু নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘যে প্রার্থী হবে স্বাভাবিকভাবেই তার পরিচিত বন্ধুবান্ধব বা এলাকার মানুষ তার ভালো চাইবে। সেদিক থেকে ডাকসু নির্বাচনে যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের প্রচার যারা চালাচ্ছেন, এটাকে স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছি। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব নয়। আচরণবিধিতেও এমন কিছু নেই।’