রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনের রাস্তায় ভাঙারি ব্যবসায়ী ও যুবদলকর্মী হিসেবে পরিচিত এক যুবককে প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও পাথর ছুড়ে হত্যার ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে নিন্দা ও ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে। নৃশংসতার সেই দৃশ্য সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই দ্রুত বিচারের দাবি উঠেছে সর্বস্তরে। একই সঙ্গে ঘটনায় বিএনপির অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ঘিরে দলটির ভেতরেই দেখা দিয়েছে অস্বস্তি।
ঘটনাটি ঘটে বুধবার সন্ধ্যায়। তবে ভিডিওটি সামনে আসে শুক্রবার, যা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। ফুটেজে দেখা যায়, ‘সোহান মেটাল’ নামের একটি ভাঙারির দোকান থেকে এক যুবককে জোর করে টেনে এনে মিটফোর্ড হাসপাতালের মূল ফটকের সামনে ফেলে লোহার রড, লাঠি, সিমেন্টের ব্লক ও পাথরের টুকরো দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়। এমনকি হামলাকারীদের দুজন লাফিয়ে পড়ে নিহত যুবকের শরীরে আঘাত করে।
নিহত যুবকের পরিবার দাবি করেছে, তিনি ওয়ারীর রজনী বোস লেনে দীর্ঘদিন ধরে ভাঙারির ব্যবসা করতেন এবং স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজনের সঙ্গে তার ব্যবসায়িক বিরোধ ছিল। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরেই তাকে হুমকি দিয়ে এলাকা ছাড়তে চাপ দেওয়া হচ্ছিল। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় হামলাকারীরা দোকানে ঢুকে কর্মচারীদের বের করে দিয়ে তাকে টেনে হাসপাতালে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই সামাজিকমাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। রাজধানীর বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ পরিচয়ে মিছিল হয়। এসব বিক্ষোভ ও অনলাইন স্ট্যাটাসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাম ইঙ্গিত করে নানা স্লোগান দেওয়া হয়।
ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানায়, পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। র্যাবের মহাপরিচালক একেএম শহিদুর রহমান বলেন, ‘ঢাকার পুলিশ এ ঘটনার তদন্ত করছে, তবে র্যাবও ছায়া তদন্ত শুরু করেছে।’
সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, অল্প সময়ের মধ্যেই চার্জশিট দিয়ে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।’
বিএনপি ঘটনার পরপরই যুবদলের দুই নেতাকে বহিষ্কার করে। পরে ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল আরও দুইজনকে বহিষ্কার করে। শনিবার যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলন করে পাঁচজনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়।
যুবদল সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না অভিযোগ করে বলেন, ভিডিও ও সিসিটিভি ফুটেজে যাদের সরাসরি হামলায় অংশ নিতে দেখা গেছে, পুলিশ তাদের বাদ দিয়ে অন্য তিনজনকে আসামি করেছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, “কেন এই তিনজনকে বাদ দেওয়া হলো? ভিডিওতে তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কারা জড়িত।”
ঘটনার পর বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও চাপের সৃষ্টি হয়। সামাজিকমাধ্যমে দলীয় কর্মীদের বেপরোয়া আচরণ এবং তারেক রহমানকে উদ্দেশ করে লেখা স্ট্যাটাস ঘিরে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এনসিপি নেতা সারজিস আলম ফেসবুকে লেখেন, ‘আপনার দলের নেতাকর্মী নামধারী কিছু নরপিশাচকে সামলান, তারেক রহমান। আওয়ামী লীগ করলে দায় শেখ হাসিনার, বিএনপি করলে দায় আপনার। এটা জনগণের সাধারণ যুক্তি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঘটনার সঙ্গে দলের কেউ জড়িত থাকলে সংগঠনের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপিকে জড়িয়ে রাজনৈতিক অপপ্রচার চালানো শুরু হয়েছে, যা একটি পুরনো অপসংস্কৃতি। অথচ খুলনায় যুবদল নেতাকে হত্যা কিংবা ইমামকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় কেউ উচ্চবাচ্য করেনি।’
তবে তিনি স্বীকার করেন, ‘বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। এখানে কেউ অপরাধে জড়ালে দল দায় এড়াতে পারে না। তাই সংগঠনের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
তিনি আরও জানান, তৃণমূল থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত নেতাকর্মীদের আচরণ, কর্মকাণ্ড এবং অতীত রেকর্ড পর্যালোচনা করা হবে। সংগঠনের ভাবমূর্তি নষ্ট করে এমন কর্মকাণ্ডে জড়িতদের আগেভাগেই চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
সূত্র: বিবিসি