‘সন্ধ্যা হলে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে হয়। এমনিতেই গরম, তার ওপর দরজা-জানালা বন্ধ করলে যেন সিদ্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। এতকিছুর পরও মশা থেকে রক্ষা নেই। হাত-পা চুলকাতে চুলকাতে আমার স্ত্রী ও মেয়ের শরীরে দাগ বসে গেছে।’ মশার যন্ত্রণা নিয়ে এমন অসহায়ত্বের কথা জানান রাজধানীর মিরপুর মাজার রোডের বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম। শুধু এই এলাকা নয়, রাজধানীর প্রায় সব এলাকায় মশা যেন এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে গেছে। মশার দাপট এখন আর ঋতুভিত্তিক কোনো বিষয় নয়, বছরজুড়ে চলমান এক নাগরিক সংকটে রূপ নিয়েছে। নগরের রাস্তা, নর্দমা, খালি জায়গায় জমে থাকা পানি ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজননস্থল হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে আপাতত স্বস্তির সুযোগ নেই। থেমে থেমে বৃষ্টি, মশা নিধনে জোর না দেওয়ার কারণে চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। এদিকে, ঢাকার আক্রান্ত সব এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণে অবিলম্বে যথাযথ ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সোমবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পদক্ষেপের বিষয়ে আগামী দুই মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
মশা মারতে প্রতি বছর শতকোটি টাকা বরাদ্দ রাখে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। নানা উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দেয় নগর কর্তৃপক্ষ। এর পরও মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) বরাদ্দ রেখেছে ১১০ কোটি টাকা। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বরাদ্দ ৪৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। বিপুল পরিমাণ এই অর্থ ব্যয়ের পরও নিয়ন্ত্রণহীন মশা। বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। দুই সিটির ১৩টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়েও বেশি। মশার উপদ্রব ও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়লেও সিটি করপোরেশনের টনক নড়ছে না।
সরেজমিন ঘুরে এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটিতে মশকনিধন কার্যক্রম জোরালোভাবে চলছে না। এতে একদিকে ডেঙ্গু আতঙ্ক, অন্যদিকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছে অস্বস্তি। মূলত ডেঙ্গুর মৌসুমেও মশা নির্মূলের কার্যক্রম নেই। ডিএসসিসিতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি।
মালিবাগ এলাকার মামুন হোসাইন বলেন, বাইরে এসে একটা জায়গায় বসা যায় না, দাঁড়ানো যায় না। ঘরের ভেতরে সন্ধ্যার পর থেকে কয়েল জ্বালিয়ে রাখি। তবু মশা দূর হয় না, অতিরিক্ত মশা বাড়ছে। এখন সিটি করপোরেশনের দিকে তাকিয়ে তো লাভ নেই। আল্লাহ ভরসা, তিনি যদি বাঁচিয়ে রাখেন। ভয়াবহ অবস্থা ডিএনসিসিতে যুক্ত হওয়া নতুন ওয়ার্ডগুলোতে। উত্তরখান, দক্ষিণখান ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে খোলা খাল থাকায় মশার উৎপাত বেড়েছে কয়েকগুণ। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, দক্ষিণখানে দিনেও মশারি ছাড়া ঘুমানো যায় না। সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কর্মীরা অনেকদিন ধরে আসেন না।
গাবতলী বাস টার্মিনাল ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এক একটি কাউন্টার ও এর আশপাশ যেন এডিস মশার বাসা। সড়কের পাশে, তেলের পাম্পে বা কাউন্টারের সামনে পানি জমে থাকে। বেশিরভাগ জায়গায় পলিথিনের ব্যাগ পড়ে আছে। বৃষ্টি হলেই এতে পানি জমে মশার প্রজনন হবে।
জুরাইন, পোস্তগোলা, শ্যামপুর কদমতলী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মশার যন্ত্রণায় দিনের বেলায় বেশিরভাগ বাসার ঘরে মশারি টানিয়ে রেখেছে। আবার কেউ কেউ দিনেও ঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মশার কয়েল কিংবা ধুপ জ্বালিয়ে রাখছেন। এসব এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। দেখে মনে হচ্ছে, গত কয়েক মাস ড্রেনেজের ময়লা পরিষ্কার করা হয়নি।
বিমানবন্দর স্টেশনের পশ্চিম পাশের পার্কিং এরিয়ায় এডিশ মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টির পানি জমে এ অবস্থা হয়েছে। এখানে একদিকে জমছে বৃষ্টির পানি, অন্যদিকে স্টেশনের পার্কিংয়ের জায়গায় গড়ে ওঠা অবৈধ দোকান থেকে পলিথিন ফেলে স্তূপ করা হয়েছে। এতেও এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
দনিয়া হাইকুলের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ বলেন, কয়েক মাস ধরে সিটি করপোরেশনের লোকজনের কাজকর্ম নেই বললেই চলে। ড্রেন ও রাস্তাঘাটগুলো পরিষ্কার করা হয় না। ড্রেন বন্ধ হয়ে যত্রতত্র ময়লা জমে আছে। নিয়মিত মশার ওষুধও ছেটানো হয় না।
মেরাজনগরের বাসিন্দা সবুজ বলেন, আমাদের কাছে দিনরাত সমান। মশার যন্ত্রণায় ঘরে-বাইরে কোথাওও শান্তি নেই।
মগবাজার এলাকার বাসিন্দা শাহিনুর রহমান বলেন, মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সব পদক্ষেপ শুধু মিডিয়া ও ফেসবুককেন্দ্রিক। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
এদিকে মশা যে নাগরিক জীবনের জন্য কতটা প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে, তা বিগত কয়েক বছরের ডেঙ্গুজ্বরে মারা যাওয়ার জরিপেই উঠে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৭৫ জন, ২০২৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৭০৫। চলতি বছরেও জানুয়ারি থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৫৪৪ জন। এর মধ্যে ৭ হাজার ৪৩০ জন রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। আর এ বছর ডেঙ্গুতে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৪ জন।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি জুলাই ও আগস্টে আরও অবনতি হতে পারে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, ‘মে মাসের চেয়ে জুনের চিত্র দ্বিগুণ খারাপ। একইভাবে জুনের চেয়ে জুলাই ও জুলাইয়ের চেয়ে আগস্টে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু দুটোই দ্বিগুণ হবে। ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করলে স্বাস্থ্য খাত পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।’
ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তিনটি বিষয় একসঙ্গে হলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়। হোস্ট, প্যাথোজেন ও এনভায়রনমেন্ট—এ তিনটাকে একত্রে বলা হয় ডিজিজ ট্রায়াড। হোস্ট হলো মানুষ, প্যাথোজেন হলো ডেঙ্গু ভাইরাস বাহক এডিস মশা ও এনভায়রনমেন্ট হলো বৃষ্টি, জমে থাকা পানি ইত্যাদি। যেসব এলাকায় ঘনবসতি আছে, পাশাপাশি মশার ঘনত্ব বেশি এবং তিন দিনের বেশি জমে থাকা পানির পাত্র রয়েছে, ওই এলাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যেতে থাকে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এম মুশতাক হোসেন বলেন, এ বছর ডেঙ্গু রোগী বাড়ার আশঙ্কা আছে। গত বছরের তুলনায় মশার প্রকোপ বেশি। গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ না নিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি অবনতির পেছনে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার ভঙ্গুরতাকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘গত বছরের আগস্টের পর থেকেই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। বর্তমানে ঢাকায় ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। ঢাকার বাইরে আগে তো সেভাবে ডেঙ্গু নিয়ে ভাবা হয়নি। এ পরিস্থিতিতে বিষয়টি আরও গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছে। নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও স্বাস্থ্য বিভাগের অবহেলার কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়। ঢাকাসহ সারা দেশেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সে অর্থে কার্যকর নয়। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এক জায়গার বর্জ্য আরেক জায়গায় নিয়ে ফেলে শুধু। এর বাইরে অন্য কোনো কার্যক্রম নেই। তা ছাড়া মশক নিধনে যে দক্ষতা ও আন্তরিকতার প্রয়োজন, তা আগেও আমরা দেখিনি, এখন আরও দেখছি না। ফলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন যে অবস্থায় আছে, তা আরও খারাপ হলেও অবাক হব না।’
জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ কালবেলাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রস্তুতি চলছে। ডিএনসিসির আওতাধীন সব হাসপাতালে ডেঙ্গু ইউনিট চালু করা হয়েছে এবং চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট প্রটোকল মেনে চলা হচ্ছে। আমরা স্কুলগুলোতে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করেছি, কারণ অনেক সংক্রমণ সেখান থেকেই শুরু হয়। হাসপাতালগুলোও ভালোভাবে পরিষ্কার করা হচ্ছে। মশা মারার ওষুধ ছিটানো দিনে দুবারের বদলে তিনবার করা হয়েছে এবং বিশেষ টিম সচেতনতামূলক প্রচার চালাচ্ছে।’
ইশরাককে মেয়র হিসেবে শপথ পড়াতে চলা আন্দোলনের কারণে ডিএসসিসির নগর ভবনে ৪০ দিন তালা ঝুলেছে। এতে নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এডিস মশার বিস্তার রোধে গত ১৪ জুন থেকে দ্বিগুণ ওষুধ ছিটানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিশাত পারভীন। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘মশা নিধন ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান জোরদারের পাশাপাশি জোনভিত্তিক মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত সাতটি ওয়ার্ডে চিরুনি অভিযান চলছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে। এ ছাড়া সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে।’