দেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। গত বছর ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো এ খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। খেলাপির হার উঠেছে প্রায় ১৬ শতাংশে। মাত্র এক বছর ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। এর মধ্যে শেষ ছয় মাসেই বেড়েছে এক লাখ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেলেও এখন বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে সেই ছোঁয়া লেগেছে। মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেসরকারি খাতের সাত-আটটি ব্যাংক এস আলমের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এসব ব্যাংক থেকে অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে বের করে নেওয়া হয়েছে, যা এখন খেলাপি হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া ঋণ শ্রেণিকরণ নীতিমালায় পরিবর্তন আনারও প্রভাব রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ৭০ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা বা ৫.৯৩ শতাংশ। সেটি গত বছর ডিসেম্বর শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৫ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ১৫.৬০ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ২৯ হাজার ৩৩ কোটি টাকা বা ১৮২ শতাংশ। এর মধ্যে গত বছর শেষ তিন মাসে বেড়েছে ৫০ হাজার ২০৯ কোটি টাকা। আর ছয় মাসের ব্যবধানে বেড়েছে এক লাখ ৯৪ কোটি টাকা। গত বছর জুন শেষে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বেসরকারি খাতের খেলাপি ঋণ মূলত কয়েকটি ব্যাংকের কারণে বেড়েছে। এ খাতের কিছু ব্যাংক যেসব অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ দিয়েছিল, তা এখন খেলাপি হয়ে পড়ছে। এসব ব্যাংকেই মোটাদাগে খেলাপি বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত এক বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭০ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে এ খাতের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪২.৮৩ শতাংশ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি বা ৪.৮২ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের মধ্যে জনতা ব্যাংকেরই ৬৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের মধ্যে বেক্সিমকোর ২৩ হাজার কোটি, এস আলম গ্রুপের ১০ হাজার ২০০ কোটি, অ্যাননটেক্সের ৭ হাজার ৮০০ কোটি, ক্রিসেন্টের ৩ হাজার ৮০০ কোটি, থার্মেক্স গ্রুপের ২ হাজার ২০০ কোটি এবং সিকদার গ্রুপের ৮৫০ কোটি টাকা।
বিশেষায়িত ব্যাংকেরও গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা বা ১৩.৮৭ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে তা বেড়ে হয় ৬ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা বা ১৪.৩৭ শতাংশ। এক বছরে এ খাতের ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৬৪ কোটি টাকা। তবে গত এক বছরে বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমেছে। গত ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪.১৩ শতাংশ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের বিতরণকৃত ঋণের ৪.৮২ শতাংশ ছিল।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গত বছর ডিসেম্বর শেষে সার্বিক ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা বা ২০.২০ শতাংশ। এক বছর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা বা ৯ শতাংশ। সেই হিসাবে এক বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ১৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে শেষ ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।
গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, আগেই বলেছিলাম খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আপাতত ভালোর দিকে যাবে না। যতই নতুন তথ্য আসছে, ততই বাড়ছে। যেভাবে ধারণা দিয়েছিলাম, সেভাবে বাড়ছে। সামনে আরও বাড়বে। আগে খেলাপি ঋণ কিছুটা কম দেখানো হতো। একসময় ছিল ৯ শতাংশ, যা বেড়ে ২০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। খেলাপি ঋণ এখনও সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছায়নি। এ ছাড়া নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আসছে। আগে ১৮০ দিন পর খেলাপি হতো, এখন ৯০ দিনে খেলাপি হয়ে পড়ছে। এ কারণেও খেলাপি ঋণ কিছুটা বাড়বে।