দেশের শেয়ারবাজারে ভালো মৌলভিত্তি কোম্পানির বড় অভাব। স্টেকহোল্ডারদের সবাই বিষয়টি স্বীকার করলেও দীর্ঘ সময়ে ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়নি। ফলে দুই যুগ ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে দেশের শেয়ারবাজার। বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাড়ানোর বিষয়টি সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে সুশাসন আর জবাবদিহিতা জরুরি। এটা না থাকলে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে ভরসা পান না। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ারের বেশ ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে ২০ থেকে ২৫টি বেশি ভালো কোম্পানির নাম বলা যায় না। তাই বাজারে ভালো কোম্পানি ও শেয়ারের সংখ্যা বাড়ানো খুবই জরুরি মনে করেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা গত ১৫ বছরে ১৩৪ প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্তি অনুমোদন করেছে। কিন্তু, কোম্পানিগুলো ভালো ফল বয়ে আনতে পারেনি। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই তালিকাভুক্ত হওয়ার পর মুনাফা করার সক্ষমতা কমেছে। ফলে তাদের জেড ক্যাটাগরিতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, পুঁজিবাজারে মন্দ শেয়ার হিসেবে পরিচিত জেড ক্যাটাগরির শেয়ার। যেসব কোম্পানি লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ, পরপর দুই বছর বার্ষিক সাধারণ সভা আয়োজন করতে ব্যর্থ, ছয় মাস বা বেশি সময় কোম্পানি উৎপাদন বা কার্যক্রম বন্ধ, পরপর দুই বছর নিট কার্যকর লোকসান অথবা পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক থাকলে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসান তার পরিশোধিত মূলধনকে অতিক্রম করলে সেসব কোম্পানির শেয়ারই মূলত জেড ক্যাটাগরিতে স্থানান্তর করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গত ১৫ বছরে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে তালিকাভুক্ত অনেক প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাজ করছে। আলোচ্য সময়ে অনুমোদন পাওয়া ১৩৪ কোম্পানির মধ্যে ৪২ শেয়ার জেড ক্যাটাগরিতে চলে গেছে। বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৫০ কোম্পানির মধ্যে ১০৩টি জেড ক্যাটাগরির মন্দ শেয়ার।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) আয়োজিত সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় শেয়ারবাজারে ভালো শেয়ারের অভাবের কথা স্বীকার করে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের শেয়ারবাজারের গভীরতা অনেক কম। ভালো ভালো কোম্পানিগুলো এই বাজারে আসতে খুব বেশি আগ্রহী নয়। এসব কোম্পানির মালিকরা ভাবেন, ছেলে হবে পরিচালক, বউ চেয়ারম্যান। ব্যবসায় যা মুনাফা হবে, তা নিজেরা ভোগ করবেন। শেয়ারবাজারে আসা মানেই ভালো ব্যবস্থাপনা, করপোরেট সুশাসন ইত্যাদি উন্নত হওয়া। কিন্তু অনেকে এসব বিষয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চান না। তাই তারা বাজারে আসতে আগ্রহী নন। কিন্তু সময় এসেছে বাজারের গভীরতা বাড়ানোর। এ জন্য ভালো ভালো কোম্পানি বাজারে আনতে হবে। তার জন্য করের সুবিধাসহ সরকারি যেসব নীতি-সহায়তা দরকার, সেসব বিষয় সরকার বিবেচনা করবে। কিছু সরকারি কোম্পানি বাজারে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) একজন পরিচালক বলেন, বিশ্বব্যাপী স্টক এক্সচেঞ্জগুলো সাধারণত বাজার নিয়ন্ত্রকদের সম্পৃক্ততা ছাড়াই প্রতিষ্ঠানকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করে। দেশে তালিকাভুক্তি প্রক্রিয়ায় বিএসইসির অতিরিক্ত জড়িত থাকার ভূমিকা এই নিয়মে বিচ্যুতি ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে আইপিও অনুমোদন পাওয়ার সুবিধার্থে এসব প্রতিষ্ঠান অনেক সময় অনেক সরকারি সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের অন্যায্য সুবিধা দিয়েছে।
বিএসইসি সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, গত ১৫ বছরে পুঁজিবাজারের গভর্নেন্স অনেক প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের বিরুদ্ধে অনেক কথা শোনা যায়। অনেক কোম্পানিকে আইপিও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে যেগুলো এখন জেড ক্যাটাগরিতে চলে গেছে। ডিএসইর কথা কর্ণপাতা না করে এসব কোম্পানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থাও নেমেছে তলানীতে।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের সদস্য মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন জানান, বড় ১৫ বছরে পুঁজিবাজারে যেসব প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) এসেছে, তার বড় অংশই নিম্নমানের। এ কারণে বাজারে প্রকৃত চাহিদা তৈরি হয়নি। অন্যের দেখাদেখি বিনিয়োগ করে অনেকেই পরে সব হারিয়েছেন।