আজ মঙ্গলবার, ১৪ জুন। বাংলা একাডেমির সভাপতি ও কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ৭৬তম জন্মদিন। ১৯৪৭ সালের এই দিনে রাজশাহী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পৈতৃক নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলার হাজিরপাড়া গ্রামে। বাবার নাম এ কে মোশাররফ হোসেন এবং মায়ের নাম মরিয়মন্নেসা বকুল। সাত ভাইবোনের মধ্যে সেলিনা হোসেন হচ্ছেন চতুর্থ।
সেলিনা হোসেন ১৯৫৪ সালে বগুড়ার লতিফপুর প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৯ সালে রাজশাহীর নাথ গালর্স স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে তিনি এখান থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। কলেজ জীবন শেষ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে বিএ অনার্স এবং ১৯৬৮ সালে এমএ পাস করেন।
দীর্ঘদিন বাংলা একাডেমিতে চাকরি করেছেন সেলিনা হোসেন। একাডেমির পরিচালক পদে থাকা অবস্থায় অবসর গ্রহণ করেন। পরে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। গত ফেব্রুয়ারিতে সেলিনা হোসেনকে বাংলা একাডেমির সভাপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে।
নন্দিত এ কথাসাহিত্যিকের লেখালেখির শুরু ষাটের দশকের মধ্যভাগে রাজশাহী মহিলা কলেজে পড়ার সময়। সেসময়ের লেখা নিয়ে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে।
উপন্যাস, ছোট গল্পের সংকলন, শিশুতোষ গ্রন্থ, প্রবন্ধ ও সম্পাদনা মিলিয়ে তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়েছে। তার অনবদ্য সৃষ্টিকর্মের মধ্যে রয়েছে, ভূমি ও কুসুম, পূর্ণ ছবির মগ্নতা, নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি, হাঙ্গর নদী গ্রেনেড, পোকা মাকড়ের ঘরবসতি, যাপিত জীবন, নীল ময়ূরের যৌবন, কাঁটাতারে প্রজাপতি, কাঠ কয়লার ছবি, নুন পান্তার গড়াগড়ি ও অন্যান্য। তার উপন্যাস ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ এ নামেই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ও গল্পে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণি যেমন উঠে এসেছে, তেমনি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সুখ-দুঃখের উপাখ্যান হয়ে উঠেছে তার লেখনিতে।
তার রচনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গণমানুষের সংগ্রাম হিসেবে চিত্রায়িত হয়েছে। যা মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ধারণা দেয়। তিনি বাঙালি জীবনের সমাজ-সংকট ও সম্ভাবনার চিত্র , ছিটমহলের মানুষের জীবন, সুবিধাবঞ্চিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনকে উপন্যাসে রূপ দিয়েছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও কর্ম নিয়েও তিনি তৈরি করেছেন অনবদ্য উপন্যাস।
তার রচিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো- ‘উত্তর সারথি’ (১৯৭১) ‘জলোচ্ছ্বাস’ (১৯৭৩), ‘জ্যোৎস্নায় সূর্যজ্বালা’ (১৯৭৩), ‘মগ্ন চৈতন্যে শিস’ (১৯৭৯), ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ (১৯৮২), ‘পদশব্দ’ (১৯৮২), ‘চাঁদবেনে’ (১৯৮৪), ‘ক্ষরণ’ (১৯৮৮), ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’ (১৯৮৯), ‘খুন ও ভালোবাসা’ (১৯৯০), ‘কালকেতু ও ফুল্লরা’ (১৯৯২), ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ (১৯৯২), ‘টানাপোড়েন’ (১৯৯৪), ‘দীপান্বিতা’ (১৯৯৭), ‘যুদ্ধ’ (১৯৯৮), ‘লারা’ (২০০০), ‘মোহিনীর বিয়ে’ (২০০১), ‘আণবিক আঁধার’ (২০০৩), ‘ঘুমকাতুরে ঈশ্বর’ (২০০৪), ‘মর্গের নীল পাখি’ (২০০৫), ‘অপেক্ষা’ (২০০৭), ‘দিনের রাশিতে গিটঠু’ (২০০৭), ‘মাটি ও শস্যের বুনন’ (২০০৭), ‘পূর্ণছবির মগ্নতা’ (২০০৮), ‘ভূমি ও কুসুম’ (২০১০), ‘যমুনা নদীর মুশায়রা’(২০১১), ‘আগস্টের একরাত’ (২০১৩), ‘গেরিলা ও বীরাঙ্গনা’ (২০১৪), ‘দিনকালের কাঠখড়’ (২০১৫) প্রভৃতি।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ড. মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪ এবং শিশু সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৫ সালে আনন সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ২০১০ সালে কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করে।
সেলিনা হোসেন ব্যক্তিগত জীবনে তিন সন্তানের জননী। তার ছোট মেয়ে ফারিয়া লারা বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রশিক্ষক বৈমানিক, যিনি ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রশিক্ষণ বিমানে উড্ডয়নকালে নিহত হন। তার নামেই ‘ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেছেন সেলিনা হোসেন।