রবিবার, ০৪:৩৫ অপরাহ্ন, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

রাসূল সা:-এর ভালোবাসা ও অনুসরণ

সময়ের কণ্ঠধ্বনি
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৩
  • ৪৩ বার পঠিত

আল্লাহ তায়ালা এ পৃথিবীতে রাসূল সা:-কে প্রেরণ করেছিলেন এই দায়িত্ব দিয়ে, তিনি আল্লাহর একক ও অবিভাজ্য সার্বভৌমত্বের অধীনে সবধরনের বাতিল ব্যবস্থাকে উৎখাত করে একটি নতুন নিরাপদ পৃথিবী রচনা করবেন। আমাদের অনেকে কেন যেন রাসূল সা:-এর ওপর অর্পিত জরুরি দায়িত্বের এই সহজ কথাটি বুঝতে চাই না। কেন চাই না, নিঃসন্দেহে সে এক বিরাট রহস্য।

আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন মানবতার কল্যাণের জন্য। তিনি বলেছেনÑ ‘তোমরাই উত্তম জাতি, তোমাদের প্রেরণ করা হয়েছে মানবতার কল্যাণের জন্য।’ তিনি আরো বলেছেনÑ ‘তাঁর সালেহিন বান্দারা পৃথিবীর বৈধ উত্তরাধিকারী।’ এটি পরিষ্কার যে, সারা পৃথিবীতে রাজত্ব করবে কাফির, মুশরিক ও মুনাফিক সম্প্রদায়, খোদাদ্রোহী ফেরাউনের দল; আর মুসলমান মুদিত চক্ষু মুত্তাকির বেশে পৃথিবীর দয়ার ওপর নির্ভর করে প্রায় কাঙালের মতো দিন গুজরান করবে, এটি হয় না এবং আল্লাহর অভিপ্রায়ও আসলে এ রকম নয়। আল্লাহ কী চান, কী তাঁর অভিপ্রায়, তাঁরই সার্বিক ও সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা নবী মুহাম্মদ সা: এবং তাঁর ২৩ বছরের নবুয়তি জিন্দেগির একাগ্র অবিরাম সাধনা ও সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃতরূপ।

আমরা তো রাসূল সা:-কে আমাদের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। সেই ভালোবাসার প্রকৃতি কী? কী জন্য আমরা ভালোবাসি? ভালোবাসা বলতে কী বুঝি? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর সহজ করার জন্য আমি কয়েকটি ভালোবাসার ধরন এখানে উল্লেখ করলাম। যেমনÑ আমরা মাকে ভালোবাসি, কারণ তিনি আমাকে ১০ মাস পেটে ধারণ করেছেন, আড়াই বছর বুকের দুধ দিয়ে আমার পুষ্টির জোগান দিয়েছেন, বুকে ধারণ করে শিশু থেকে যৌবনে পৌঁছে দিয়েছেন। আর আল্লাহর নির্দেশ তো আছেই। বাবাকে ভালোবাসি, কারণ বাবার সব ঘাম ঝরানো পরিশ্রম আমার জন্যই ছিল। ভাইবোনকে ভালোবাসি, কারণ তারা একই মায়ের পেট থেকে একই রক্তে-মাংসে গড়া। স্ত্রীকে ভালোবাসি, কারণ সে হলো আমার জীবন চলার পথে একান্ত সাথী। সন্তানদের ভালোবাসি কারণ এরা আমার হৃদয়ের গ্রন্থি ও আমার পরবর্তী প্রজন্ম। শিক্ষক-উস্তাদকে ভালোবাসি, কারণ তারা আমার আলোকিত পৃথিবীর পথপ্রদর্শক। সমস্ত মুসলিম উম্মাহকে ভালোবাসি কারণ এরা আমার শরীরের অঙ্গ-পতঙ্গের মতো হৃদয়ের অংশ। এখানে লক্ষণীয় যে, একজনের ভালোবাসার কারণ অন্যজন থেকে ভিন্ন। এখন আপনার জন্য সহজ হবে, বলুন কেন কী কারণে আমরা রাসূল সা:-কে ভালোবাসি?

আমরা আল্লাহকে ভালোবাসি কারণ তিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা, আমাদের রব, আমাদের মনিব, আমরা তাঁর গোলাম। তিনি সার্বিকভাবে আমাকে লালন-পালন করেন, খিদে পেলে তিনি আমাদের খাওয়ান, তৃষ্ণার্ত হলে পান করান, অসুস্থ হলে শেফা দেন, আপদে-বিপদে তিনিই আমাদের রক্ষা করেন। দু’টি চোখে পৃথিবীর আরো যত নিয়ামত আমরা দেখি বা ভোগ করে থাকি, তা আমাদের সেই মহান প্রভুই জোগান দিয়ে থাকেন।

আমাদের সেই প্রিয় মহামনিব আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘হে নবী! তুমি বলো, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন।’ তা ছাড়া স্বয়ং নবী সা: বলেছেন, ‘আল্লাহর জন্য গ্রহণ করো এবং আল্লাহর জন্যই ত্যাগ করো।’ এটিই হলো রাসূল সা:-সহ মুসলিম উম্মাহকে ভালোবাসার প্রকৃত মানদণ্ড। আর এ কারণেই আমরা রাসূল সা:-কে ভালোবাসি। অর্থাৎ রাসূল সা:-এর প্রতি ভালোবাসা হলো দ্বীনের জন্য তথা ইসলামী জীবনব্যবস্থার জন্য, যেই দ্বীন আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক মনোনীত, যেই জীবনব্যবস্থা অন্যান্য জীবনব্যবস্থার ওপর বিজয়ী করার জন্য আল্লাহ তাঁর নবীকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সেই জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এ জন্য তাঁকে পাহাড়সম বিশাল বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। নিজের পরিবার, সমাজ ও দেশের কায়েমি স্বার্থবাদীদের নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। শুষ্ক মরুভূমির তপ্ত বালুকায় নিজের রক্ত ঝরাতে হয়েছে। ‘শিয়াবে আবু তালিব’-এ জেল জীবন বরণ করতে হয়েছে। একটি ইসলামী সমাজের মডেল প্রদর্শনের জন্য নিজের প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে মদিনায় হিজরত করতে হয়েছে। সেখানে তিনি একটি পরিপূর্ণ ইসলামী সমাজ কায়েম করে পৃথিবীবাসীর সামনে তার সুফল বাস্তবে দেখিয়ে গেছেন।

বিদায় হজের ভাষণের মাধ্যমে রাসূল সা: সেই দায়িত্ব পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দিয়ে গেছেন এবং এ দায়িত্ব বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে পালন করতে হবে। এই দায়িত্ব পালন করা হলে কেবল রাসূল সা:-এর প্রতি ভালোবাসার দাবি করা যাবে। অর্থাৎ রাসূলকে ভালোবাসা মানে তাঁর কাজকে ভালোবাসা, রাসূলকে ভালোবাসা মানে তাঁর অনুসরণে দাওয়াতে দ্বীনের জন্য ইস্পাতকঠিন ঈমান, প্রজ্ঞা এবং সার্বিক প্রচেষ্টা নিয়োগ করা। রাসূলের সুন্নাহ অনুসারে তাঁর মিশনকে এগিয়ে নেয়ার সব প্রচেষ্টাই হবে আশেকে রাসূলের প্রকৃত কাজ। সুন্নাহর অনুসরণ বলতে এই প্রচেষ্টার সমষ্টিকে বোঝায়।

পুরো পৃথিবী এখন একটি উত্তপ্ত কড়াই। কোথাও শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি, মারামারি, জবরদখল এবং মানবতাহীনের বিস্তার লাভ করেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান প্রাণী মানুষ, যাদের বসবাসের জন্য মহান আল্লাহ পৃথিবী নামক গ্রহটি সৃষ্টি করেছেন, এখানে তাদের জীবন এখন যেকোনো কিছুর তুলনায় অত্যন্ত সস্তা। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে, মানুষ তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ভুলে গেছে। তারা ভুলে গেছে আল্লাহ, রাসূল এবং আল-কুরআনের নির্দেশাবলি। ভোগের সাম্রাজ্যে নিজেদেরকে এতটাই সম্পৃক্ত করে ফেলেছে যে, স্বার্থবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অক্টোপাসের মতো ঘিরে ফেলেছে এবং অধঃপতনের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

আজ বিশ্বপরিস্থিতি এবং পুরো বিশ্বের সমাজব্যবস্থায় যে অবক্ষয় সৃষ্টি হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হচ্ছে, মানবতা চরমভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে, ন্যায়বিচারের আশা, সত্য সুন্দরের কামনা, কল্যাণ-মহৎবৃত্তির পরিচর্যা আজ প্রতারণার শিকার। রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা তথা সামগ্রিক জীবনব্যবস্থা পর্যুদস্ত। হিংসা-বিদ্বেষ, কলহ-দ্বন্দ্ব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবিষ্ট হয়ে জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এর কি কোনো প্রতিকার নেই? হ্যাঁ আছে। এই সমূহ পতন থেকে রক্ষা পেতে হলে অবশ্যই রাসূল সা:-এর প্রতিষ্ঠিত ও প্রদর্শিত কর্মকৌশল গ্রহণ করতে হবে। এটিই হবে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, এটিই হবে রাসূল সা:-এর প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা। আর এটিই হবে রাসূল সা:-এর প্রকৃত অনুসরণ, রাসূল সা:-এর সুন্নাহর প্রকৃত অনুসরণ।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মানবতার এমনই এক সন্ধিক্ষণে রাসূল সা: এসেছিলেন। যিনি বিশ্বের যাবতীয় সমস্যার সামগ্রিক সমাধান দিয়েছিলেন। ব্যক্তি ও সমষ্টি জীবনের সব সমস্যা দূর করে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছিলেন সবার জন্য শান্তি। তাঁর কালের ও অগণিত ভবিষ্যতের সব মানুষের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেলেন সুষ্ঠু জীবনব্যবস্থার। এই আমোঘ অস্ত্রটি আত্মপ্রত্যয়ের সাথে যদি আজো প্রয়োগ করা হয় তবে দিশেহারা বিশ্বে শান্তি ফিরে আসবে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই, মুসলিমবিশ্ব রাসূল সা:-এর সেই আমোঘ অস্ত্রটি হারিয়ে ফেলেছে। তাঁর জীবনের আদর্শ থেকে বহু দূরে চলে গেছে। ভোঁতা সব অস্ত্রে শাণ দিতে দিতে মুসলমানরা অনেকটা ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু রাসূল সা:-এর সেই অস্ত্রের মতো ঝিলিক সৃষ্টি করতে পারেনি। কখনো পারবে না। রাসূল সা:-এর আদর্শে ফিরে আসতেই হবে।

রাসূল সা:-কে ভালোবাসি কিন্তু তাঁর কর্মনীতি, কর্মপন্থা গ্রহণ করব না, তাঁর প্রদর্শিত পথে চলব না, এটিকে কি ভালোবাসা বলা যায়? কখনো নয়। রাসূল সা:-কে ভালোবাসা মানে তাঁকে অনুসরণ করা। বর্তমান অশান্ত পৃথিবীকে মানুষের বাস উপযোগী করার জন্য মানুষের কল্যাণের নিমিত্তে কাজ করার জন্য প্রয়োজন তাঁর অনুসরণ; নিজেদের স্বার্থবাদী চিন্তা ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে ছুড়ে ফেলে তাঁর সোনালি সমাজ বিনির্মাণ।

রাসূল সা:-এর ওফাতের পর তাঁর সাহাবিরাও তাঁর নির্দেশিত পথে তাঁদের সামগ্রিক প্রয়াস অব্যাহত রেখেছিলেন, তাঁর অনুসরণের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র শিথিলতা প্রদর্শন করেননি। ফলে ইতিহাস সাক্ষী তাঁরা যে এলাকায় গেছেন, সেখানকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ সব ক্ষেত্রে বিশেষ স্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, চরিত্র-মাধুর্য, যোগ্যতা, শিষ্টাচার, দক্ষতা, শিল্প-সাহিত্য, ব্যবসাবাণিজ্য সার্বিক দিকে বৈপ্লবিক পরির্বতন সূচিত হয়েছে।

লেখক :

  • জাফর আহমাদ

শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com