নাজমিন সুলতানার ছোট মেয়ে কথার বয়স ছয় বছর। জ্বরে একেবারে বেহাল। শারীরিক দুর্বলতা, বমি, ডায়রিয়া সবই আছে। একই অবস্থা নাজমিন সুলতানার গাড়িচালকের মেয়েরও। সব মিলিয়ে অবস্থা বেহাল জানিয়ে নাজমিন সুলতানা বলেন, হাসপাতালে নাকি বেডই খালি হচ্ছে না!
আমিনা সুলতানার সাড়ে চার বছরের মেয়ে ফাতিমা। প্রথমে জ্বর, হাত-পায়ে ব্যথা, সেই সঙ্গে রক্তক্ষরণ। ফাতিমা বর্তমানে রাজধানীর বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। মেয়ের অবস্থার কথা জানিয়ে মা বললেন, সব লক্ষণই ডেঙ্গুর, কিন্তু পরীক্ষায় এসেছে ডেঙ্গু নেগেটিভ।
আইসিইউর ভেতরে মেয়েকে রেখে দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মা আমিনা সুলতানা ধরা গলায় বলেন, ‘আমার মেয়েকে আপনাদের দোয়ায় রাখার আরজি রইল।’
চলতি বছরে কেবল ফাতিমা কিংবা কথাই নয়, ঘরে ঘরে যত মানুষ জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন, ডেঙ্গু পরীক্ষায় অনেকেই ডেঙ্গু নেগেটিভ বা আক্রান্ত নন বলে ঘোষিত হচ্ছে। অর্থাৎ ডেঙ্গু পরীক্ষায় সবার ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে না, লেখা থাকছে নেগেটিভ। আর সেটা ধরে নিয়েই তারা অনেকটা নির্বিকার থাকছেন। আর সেটাই হয়ে যাচ্ছে ভয়ের কারণ। ডেঙ্গু নয় ধরে বাসায় চিকিৎসা করা হচ্ছে, আর তাতে শরীরের ভেতরে সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। শেষ সময় যখন হাসপাতালে আসতে হচ্ছে, তখন আর চিকিৎসকদের কিছু করার থাকছে না।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, ডেঙ্গুর চারটি ধরন রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ডেঙ্গুর ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ এবং ডেন-৪। চলতি বছরে ডেন-২ দিয়ে মানুষ বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। সীমিতসংখ্যক নমুনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ রোগী ডেঙ্গুর ধরন ডেন-২। বাকি ৩৮ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন অন্য ধরন ডেন-৩-এ। আইইডিসিআর এ তথ্য জানিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার যদি ডেন-২-এর পরিমাণ বেশি থাকে এবং মানুষ যদি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হন, তাহলে রোগের জটিলতা বেশি হওয়ার ঝুঁকি আছে।
আইইডিসিআর উপদেষ্টা ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন দৈনিক বাংলাকে বলেন, ডেঙ্গুর চার ধরনের মধ্যে কোনো একটি ধরনে আক্রান্ত হলে সেই নির্দিষ্ট ধরনের প্রতিরোধক্ষমতা শরীরে গড়ে ওঠে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে একই ধরনে মানুষ আর আক্রান্ত হন না, অন্য ধরনে আক্রান্ত হতে পারেন। এভাবে মোট চারবার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আর প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে রোগের তীব্রতা ও জটিলতা দুটিই বাড়ে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন জানিয়েছেন, আইইডিসিআর ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করেছে। তাদের নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ নমুনায় ডেন-২ শনাক্ত হয়েছে। আর ৩৮ শতাংশ নমুনায় ডেন-৩ শনাক্ত হয়েছে।
তাহমিনা শিরিন বলেন, ২০২২ সালের নমুনা বিশ্লেষণে প্রাধান্য ছিল ডেন-৩-এর। ৯০ শতাংশ রোগী আক্রান্ত হয়েছিলেন ডেন-৩-এ। বাকি প্রায় ১০ শতাংশ ছিলেন ডেন-৪। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম একাধিকবার বলেছেন, হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে ডেঙ্গুর ‘শক সিনড্রোম’ বেশি দেখা যাচ্ছে, তাদের জটিলতাও বেশি। আর তাতে মৃত্যুও হচ্ছে বেশি।
আর চিকিৎসকরা বলছেন, এবার ডেঙ্গুতে পজিটিভ হওয়ার পাশাপাশি পরীক্ষায় ডেঙ্গু নেগেটিভ রোগীও তারা অনেক বেশি পাচ্ছেন। কিন্তু তাদের লক্ষণ সব ডেঙ্গুর মতোই। সে বিবেচনা করে তারা নেগেটিভ রোগীদেরও ডেঙ্গুর ট্রিটমেন্ট প্রটোকল অনুযায়ী চিকিৎসা দিচ্ছেন।
রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ২৪ জন রোগী ভর্তি আছে। তার মধ্যে মাত্র চারজন ডেঙ্গু পজিটিভ, বাকি সবাই নেগেটিভ। কিন্তু তাদের সবাইকে ডেঙ্গু কর্নারে রেখেই ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। জানতে চাইলে রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালের ইমার্জেন্সি অ্যান্ড আইসিইউ কনসালট্যান্ট ডা. আশরাফ জুয়েল দৈনিক বাংলাকে বলেন, “নেগেটিভ রোগী বেশি নিয়ে আমরা আজকেই কথা বললাম হাসপাতালে। এটা কয়েক দিনের মধ্যেই ‘ইস্যু’ হবে।”
ডা. আশরাফ জুয়েল বলেন, ডেঙ্গুর সেরোটাইপ-২-এর ১৫টি স্ট্রেইন বা ধরন রয়েছে। এর মধ্যে ৯টি ধরন দক্ষিণ এশিয়ায় সংক্রমণে দাপট দেখাচ্ছে। কিন্তু সব পরীক্ষায় সব ধরন শনাক্ত হয় না। আরটিপিসিআর করলে ধরন শনাক্ত করা সম্ভব, কিন্তু ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে সরকারিভাবে কোথাও এটা করা হয় না। ফলে ধরন সঠিকভাবে শনাক্ত হচ্ছে না।
‘তবে এটা এখন সময়ের দাবি যে, ডেঙ্গু পরীক্ষায় এখন আরটিপিআর করা হোক। যেটা করোনার সময়ে করা হতো’, বলেন ডা. আশরাফ জুয়েল। এদিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান খান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘দেশে যে পরীক্ষা হয় ডেঙ্গুতে, তাতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশের মতো নমুনার সঠিকতা পাওয়া যায় না।’
ডেঙ্গু ভাইরাসের উপস্থিতি জানার জন্য যে পরীক্ষাগুলো করা হয়, সেগুলো ফলস পজিটিভ এবং ফলস নেগেটিভ, দুই ধরনের রেজাল্ট দিতে পারে। অর্থাৎ আপনার শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস থাকলেও নেগেটিভ রেজাল্ট আসতে পারে, আবার আপনার শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস না থাকলেও পজিটিভ রেজাল্ট আসতে পারে। এ ধরনের পরীক্ষার রেজাল্ট পরীক্ষা করার পদ্ধতি, কিটের গুণগত মান এবং ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার কতদিন পর পরীক্ষাটি করা হচ্ছে, এরকম অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে বলে জানান ডা. জাহিদুর রহমান।
আর অ্যান্টিবডির যে পরীক্ষা হয় তার সেনসিটিভিটি কম মন্তব্য করে তিনি বলেন, যে র্যাপিড টেস্ট করা হয় তার সেনসিটিভিটি আরও কম। একটাই সুবিধা যে, দ্রুত পরীক্ষা করা যায়।
চলতি বছরে রোগী ৩৫ হাজার পার
গত রোববার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সোমবার একই সময় পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ রোগী ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। আর তাতে করে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে মোট রোগীর সংখ্যা ৩২ হাজার থেকে পার হয়ে গেল ৩৫ হাজারের বেশি। আর গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যু হলো ১৮৫ জনের। তাতে করে দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুকে পেছনে ফেলল বছরের প্রথম সাত মাসেই। এর আগে ২০১৯ সালে ১৭৯ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছিল অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ২৯৩ জন। তাদের মধ্যে ঢাকা মহানগরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ২৩৮ জন আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৫৫ জন। গত রোববার ২ হাজার ২৯২ জন ভর্তি হওয়ার তথ্য দিয়েছিল। এ নিয়ে টানা তিন দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়েছে।
অধিদপ্তর জানাচ্ছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের আর তারা সবাই ঢাকা সিটির বাসিন্দা।
অধিদপ্তর জানাচ্ছে, গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২ হাজার ২৯৩ জনকে নিয়ে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে মোট ভর্তি হয়েছেন ৩৫ হাজার ২৭০ জন। তাদের মধ্যে ঢাকা সিটির হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২১ হাজার ১৮৭ জন আর ঢাকা সিটির বাইরের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪ হাজার ৮৩ জন। মোট ৩৫ হাজার ২৭০ জনের ভেতর চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২৭ হাজার ৬২২ জন আর বর্তমানে চিকিৎসাধীন ৭ হাজার ৪৬৩ জন। অধিদপ্তর জানাচ্ছে, চলতি মাসে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৭ হাজার ২৯২ জন আর মৃত্যু হয়েছে ১৩৮ জনের।
ডেঙ্গুতে গত জুন মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৫ হাজার ৯৫৬ জন। সে সময় মারা যান ৩৪ জন। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬, মার্চে ১১১, এপ্রিলে ১৪৩ এবং মে মাসে ১ হাজার ৩৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। মারা যান জানুয়ারিতে ছয়জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন এবং এপ্রিল ও মে মাসে দুজন করে।
দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ নজরে আসে ২০০০ সালে। এরপর সবচেয়ে ডেঙ্গুর বেশি রোগী শনাক্ত হয় ২০১৯ সালে। সে বছর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন এবং মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় ২০২২ সালে, ২৮১ জনের।