রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা ও ডলার সংকটে বিনিয়োগের গতি ক্রমশ মন্থর হয়ে পড়ছে। চলমান অস্থির পরিস্থিতিতে নতুন করে বিনিয়োগে কেউ সাহস করছেন না। আবার গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বিদ্যমান ব্যবসা সম্প্রসারণেও অনেকের আগ্রহ কমেছে। এতে শিল্প স্থাপনের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলা ব্যাপক হারে কমে যাচ্ছে। এর প্রভাবে বেসরকারি খাতের ঋণেও ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে আশানুরূপভাবে বাড়ছে না বিদেশি বিনিয়োগও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৬৭ শতাংশ। একই সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। আর শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছে, রিজার্ভ সাশ্রয়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয়ে লাগাম পড়েছে এটা ভালো দিক। তবে চিন্তার বিষয় হলো- মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামালের এলসি খোলা কমে যাওয়া। এতে দীর্ঘমেয়াদে শিল্প উৎপাদন, রপ্তানি ও কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জিডিপিতেও।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য খারাপ বার্তা দিচ্ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ কমবে। যার প্রভাব পড়বে জিডিপি ও কর্মসংস্থানে। তিনি আরও বলেন, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গোটা বিশ্বই কঠিন সময় পার করছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। আমাদের প্রবাসী আয় নিম্নমুখী প্রবণতায় রয়েছে। রপ্তানি অর্ডার কমে গেছে। দেশ থেকে অর্থপাচার বেড়েছে। এই অবস্থায় ডলারের সংকট ও দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। অন্যদিকে আমদানি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও কড়াকড়ি
আরোপ করা হয়েছে। এতে বিভিন্ন পণ্যের এলসি কমে গেছে।
সাধারণত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করে থাকেন। ফলে এই পণ্যটির আমদানি বাড়লে দেশে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আর বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে, যার প্রভাব পড়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। ব্যবসায়ীরা ও শিল্পোদ্যোক্তারা জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অনিশ্চয়তা ও ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খোলা কমিয়ে দিয়েছেন তারা। এ ছাড়া ডলারের সংকটের কারণেও অনেক ব্যাংক মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খোলা থেকে বিরত রয়েছে।
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আমাদের সময়কে বলেন, দুটি কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি কমেছে। প্রথমত চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় নতুন করে কেউ বিনিয়োগে যেতে সাহস করছে না। একই কারণে বিদ্যমান ব্যবসা সম্প্রসারণেও আগ্রহ কমেছে। দ্বিতীয়ত ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকের দিক থেকে এলসি খোলায় অনীহা দেখানো হচ্ছে যে, এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না ইত্যাদি। অন্যদিকে শিল্পের কাঁচামালের এলসি খোলা কমে যাওয়ার কারণও দুটি। এগুলো হলো- আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের রপ্তানি অর্ডার কমে গেছে। দ্বিতীয়ত বিদ্যমান যেসব রপ্তানি অর্ডার এসেছে, সেটার অধিকাংশ কাঁচামাল দেশীয় উৎস থেকেই সংগ্রহের মাধ্যমে কাভার করা হয়েছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের কারণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সামনে কোনো অনিশ্চয়তা দেখছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন কোনো ফ্যাক্টর নয়। বরং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট ও ব্যাংকগুলোর অনীহা প্রভৃতি বিষয় পর্যবেক্ষণ করে ব্যবসায়ীদের অনেকেই নতুন বিনিয়োগ থেকে দূরে আসে।
করোনা পরিস্থিতি উন্নতির পর অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় ২০২১ সালের আগস্ট থেকে দেশে আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক গতিতে বাড়তে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ফলে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে। কমতে শুরু করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এ পরিপ্রেক্ষিতে রিজার্ভ সাশ্রয়ে গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একের পর এক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিশেষ করে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্যের আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া এখন আমদানির ক্ষেত্রে ৩০ লাখ ডলারের বেশি ঋণপত্র খোলার তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব কড়াকড়ির কারণে যেসব পণ্যের আমদানিতে এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়নি, সেসব পণ্যের এলসি খোলায়ও অনীহা দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো। যেমন : মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করা না হলেও গত কয়েক মাস ধরে এ দুটি পণ্যের এলসিও অস্বাভাবিকভাবে কমছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খোলা হয়েছে মাত্র ১৪১ কোটি ২৮ লাখ ডলারের। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এই পণ্যটির এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৪২৫ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। অন্যদিকে এ সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১ হাজার ৩৮৪ কোটি ৮৮ লাখ ডলারের, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এই পণ্যটির এলসি খোলা হয়েছিল ১ হাজার ৯৭০ কোটি ৮২ লাখ ডলার। এ ছাড়া এ সময়ে শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে ৩০০ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৩০ শতাংশ কম।
বেসরকারি ঋণেও ধীরগতি : গত দুই মাস ধরে বেসরকারি খাতে ঋণের গতি ধীর হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে এ খাতে বার্ষিক ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। এটি চলতি অর্থবছরের অন্য মাসগুলোর তুলনায় সবচেয়ে কম। আগের মাস ডিসেম্বরে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এ ছাড়া নভেম্বরে ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ, অক্টোবরে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ, আগস্টে ১৪ দশমিক শূন্য ৭ ও জুলাইয়ে ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা আছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
বিদেশি বিনিয়োগও আশানুরূপ নয় : এ সময়ে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও (এফডিআই) আশানুরূপ বাড়েনি। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে মাত্র ১৩৪ কোটি ডলারের নিট এফডিআই এসেছে। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে মাত্র ৪ শতাংশ বেশি। একই সময়ে শেয়ারবাজারে বিদেশিদের পোর্টফলিও বিনিয়োগ আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। এ সময়ে নিটি পোর্টফলিও বিনিয়োগ ঋণাত্মক ধারায় নেমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, দেশীয় বিনিয়োগ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে বিদেশি বিনিয়োগ আসা না আসার বিষয়টি। ডলার সংকটসহ বিভিন্ন কারণে এখন দেশের অর্থনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতি যাচ্ছে। ফলে নতুন বিনিয়োগ থমকে গেছে। এ ছাড়া সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সব মিলে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন সবাই।