দীর্ঘদিন ধরেই দেশে চালের বাজারে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা দেখা যাচ্ছে। মহামারী করোনার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর গত দুই বছরে দেশে চালের দাম ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। এমনকি প্রতিবেশী ভারতসহ এশিয়ায় চালের অন্যান্য বৃহৎ ভোক্তা দেশের চেয়েও এ বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজারেও কোনো সুখবর নেই। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, বিশ্বে চালের দাম চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়, যা আমদানিকারক দেশগুলোর জন্য উদ্বেগজনক।
বৈশ্বিক বাজারে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা দেশে চাল আমাদানিতেও লেগেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের আমদানি প্রায় উল্লেখযোগ্যভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে আগামী দিনেও সুখবর নেই বলে জানিয়েছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের চাল ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বৈশ্বিক মূল্যের ক্রমবর্ধমান দরপতনের সঙ্গে সঙ্গে ডলার সংকটে চালের বাজারে প্রভাব পড়েছে। চাল আমদানিকারক শামসুল ইসলাম জানিয়েছেন, ভারত থেকে প্রতিটন চাল আমদানিতে ন্যূনতম মূল্য ৩৯০ ডলার এবং এর সঙ্গে শুল্ক ও আমদানি খরচসহ কেজিপ্রতি চালে খরচ পড়ে ন্যূনতম ৫৭ টাকা। বেশিরভাগ আমদানিকারক মাঝারি জাতের রত্না, ব্রি ধান ২৮, স্বর্ণা-৫ ও চিকন জাতের ‘মিনিকেট’ ও নাশিরশাইলের মতো চাল আনার চেষ্টা করছেন।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, বেসরকারি খাতকে বিদেশ থেকে ১ দশমকি ৪৫ মিলিয়ন টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত মাত্র দশমিক ৪০৯ মিলিয়ন টন আমদানি করেছে তারা। তিনি আরও বলেন, চলতি অর্থবছরে সরকার এ পর্যন্ত দশমিক ৪৫ মিলিয়ন টন চাল আমদানি করেছে এবং আরও দশমিক ৫ মিলিয়ন টন আমদানি করবে। সরকারের খাদ্য মজুদ তথ্যানুসারে, সরকারের গুদামে ১ দশমকি ৯৮ মিলিয়ন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। এর মধ্যে চাল মজুদ রয়েছে ১ দশমিক ৫৯ মিলিয়ন টন। এছাড়াও এখন আমন সংগ্রহের কাজ চলমান রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে মোটা চালের দাম কিছুটা কমলেও সরু চালের দাম বেড়েছে। চলতি বোরো মৌসুমে উৎপাদন খরচও রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় স্বস্তির কোনো লক্ষণ নেই।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, মোটা চালের দাম প্রতি কেজি ৪৮-৫২ টাকায় অপরিবর্তিত থাকলেও এক মাসে মাঝারি ও সরু জাতের চালের দাম প্রতি কেজিতে আরও ২-৩ টাকা বেড়ে যথাক্রমে ৬২-৬৮ টাকা এবং ৭৫-৮৮ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। যা এক বছর আগের তুলনায় ৬-১২ শতাংশ বেশি।
জানা গেছে, গোটা বিশ্বে চাল উৎপাদনে তৃতীয় বাংলাদেশ। বর্তমানে এখানকার অর্থনীতির সার্বিক মূল্যস্ফীতিতেও বড় ভূমিকা রাখছে চালের বাজার।
বাজারে দেশের এই প্রধান খাদ্যশস্যটির দাম বারবার অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার পেছনে প্রধানত সরকারের দুর্বল মজুদ ব্যবস্থাপনা এবং দ্বিতীয়ত খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততাকে দায়ী করে থাকেন পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, মূলত বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগীর অনিয়ন্ত্রিত উত্থান, কার্যকর ও দক্ষ সরবরাহ চেইন না থাকা, চালের মজুদ ধারাবাহিকভাবে উচ্চপর্যায়ে না রাখা ও মনিটরিংয়ের অভাবেই চালের বাজারের দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে যেতে দেখা যায়। এ মুহূর্তে বাজারে মনিটরিং বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি ও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে চালের মজুদ ও সরবরাহ বাড়ানোও প্রয়োজন।
চালের বাজারমূল্য বারবার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার পেছনে বাজারের নিয়ন্ত্রণ গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে চলে যাওয়াকে দায়ী করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অর্থায়নসহ নানা বৈষম্যের কারণে বাজারের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নষ্ট হয়ে পড়েছে। এর সুবাদে বৃহদায়তনের ব্যবসায়ীরা আরও বড় হয়ে ওঠার সুযোগ পেলেও বহু চালকল মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন।