২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যতম ঘোষণা ছিল, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ’। এমন ঘোষণা দিয়ে দলটি টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন হয়। কিন্তু বর্তমান মেয়াদের চার বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে তা আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, দুর্নীতির লাগাম টানার পদক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, সংস্থাটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার পথেই হাঁটছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা চারদলীয় জোট সরকার আমলে দুর্নীতির সূচকে এক নম্বরের তুলনায় এখন ১৩ নম্বরে থাকাকে উন্নতি হিসেবে উল্লেখ করে বলছেন, সরকার শূন্য সহনশীলতার নীতিতে অটল আছে। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা
নীতি’ ঘোষণা করে ইশতেহারে বলা হয়েছিল, দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ জোরদার করা হবে। ঘুষ, অনোপার্জিত আয়, কালো টাকা, চাঁদাবাজি, ঋণখেলাপি, টেন্ডারবাজি ও পেশীশক্তি প্রতিরোধ এবং দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) তথ্য বলছে, বাংলাদেশের দুর্নীতির যে চিত্র তা গত এক দশকের মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করলেও তা বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলে মনে করে জার্মান ভিত্তিক সংস্থা টিআইবি। এ ছাড়া কোম্পানি সংক্রান্ত সিপিডির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ব্যবসার জন্য বড় বাধা হচ্ছে ‘দুর্নীতি’। সংস্থাটির এক জরিপে বলা হয়, ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যবসায়ী মোটা দাগে দুর্নীতিকে ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি সঠিকভাবেই নির্ধারিত হয়েছে বলে মনে করছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা। এ নীতিকে সামনে রেখে লক্ষ্য বাস্তবায়নে সংস্থাটির সার্বিক কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে।
গত ৩১ জানুয়ারি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) দুর্নতির বৈশ্বিক সূচক প্রকাশ করে। এ সংস্থাটির বিচারে ২০২২ সালে বাংলাদেশে দুর্নীতি পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সংস্থাটির দুর্নীতির বৈশ্বিক ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের একধাপ অবনমন ঘটেছে। তাদের প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকের (সিপিআই) ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী (ভালো থেকে খারাপ) বিশ্বের ১৮০টি দেশ এবং অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এবার ১৪৭ নম্বরে। ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী গতবারও এ তালিকায় বাংলাদেশ ১৪৭ নম্বরে ছিল। আবার অধঃক্রম অনুযায়ী (খারাপ থেকে ভালো) বিবেচনা করলে বাংলাদেশের অবস্থান এবার ১৮০ দেশের মধ্যে দ্বাদশ, যেখানে গত বছর ছিল ত্রয়োদশ অবস্থানে।
টিআইয়ের সূচক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের এবারের স্কোর ২০১৪ ও ২০১৫ সালের অনুরূপ এবং অবস্থান ২০১০ ও ২০২০ সালের অনুরূপ; অর্থাৎ দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। সর্বশেষ এগারো বছরে বাংলাদেশের স্কোর ঘুরেফিরে ২৫ থেকে ২৮-এর মধ্যেই রয়েছে।
এ ছাড়া গত ২৯ জানুয়ারি সিপিডির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিতিশীলতা, মূল্যস্ফীতির মতো সমস্যা সামনে এলেও ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা ‘দুর্নীতিকেই’ দেশে ব্যবসার জন্য বড় বাধা হিসেবে দেখছেন। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত পরিচালিত এ জরিপের ফলে বলা হয়, ২০২২ সালে ব্যবসায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল দুর্নীতি। জরিপে ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যবসায়ী মোটা দাগে দুর্নীতিকে ব্যবসা ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখেন। এর মধ্যে কর দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলেছেন ৪৮ শতাংশ ব্যবসায়ী; লাইসেন্স নেওয়ার ক্ষেত্রে বলেছেন ৫৪ শতাংশ; গ্যাস, বিদ্যুৎসেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ এবং আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলছেন ৭৫ শতাংশ ব্যবসায়ী।
ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইশতেহারে দুদককে যুগোপযোগী করে আধুনিকায়ন করার পাশাপাশি দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং প্রায়োগিক ব্যবহারে সরকার সহযোগিতা করবে বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
দুদক সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে কমিশনে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান বা মামলার তদন্তের সময় জব্দ করা আলামত কম্পিউটার, মোবাইল, ডিভিআর, রেকর্ড করা অডিও-ভিডিও ফরেনসিক পরীক্ষা করতে পারবে সংস্থাটি। এ ছাড়া গত ১ জানুয়ারি থেকে সফটওয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে ‘ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড প্রসিকিউশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’- ‘আইপিএমএস’ নামে একটি প্রক্রিয়া চালু করেছে দুদক। এই আইপিএমএস সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে কমিশনে অভিযোগ দায়ের, অনুসন্ধান, তদন্ত এবং প্রসিকিউশনের কার্যক্রম অভ্যন্তরীণভাবে এক ক্লিকেই জানার সুযোগ হয়েছে।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, গত তিন বছরে দুদকের জনবল প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। এ সময়ে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ ও কর্মীদের দেড় শতাধিক পদোন্নতির পাশাপাশি নতুন করে আরও ১৪টি সমন্বিত জেলা কার্যালয় চালু করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।
দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান আমাদের সময়কে বলেন, ‘জিরো টলারেন্স নীতি সঠিকভাবেই নির্ধারণ করা হয়েছে। এই নীতি থেকে আমরা বিচ্যুত হয়নি। এই নীতির প্রশ্নে কোনো আপস নেই। কিন্তু এই নীতি বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা, বাস্তবায়ন করতে পারছি কিনা- এ প্রশ্ন তোলা হলে আমি বলব, অনেক ক্ষেত্রে আমরা পেরেছি। তবে জিরো টলারেন্স নীতি আমরা শতভাগ বাস্তবায়ন এখনো করতে পারিনি। তবে আমরা ওই দিকেই যাচ্ছি। জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, ‘সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি মেনে চলা হবে। এটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন তা আমরা দেখতে পাইনি। আরেক দিকে, যারা উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ খুব বিরল- এমন দৃষ্টান্ত খুবই কম। ক্ষমতার অবস্থানকে, সেটি রাজনৈতিক, আর্থিক বা প্রশাসনিক হোক তা ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করার যে সংস্কৃতি, সেটি আরও বেশি ঘনীভূত হয়েছে।’
সিপিডির গবেষণার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আমাদের সময়কে বলেন, ‘নির্বাচনী ইশতেহারে ক্ষমতাসীন দল দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ ঘোষণা করেছিল। এ বিষয়ে তারা রাজনৈতিকভাবে কমিটেড (অঙ্গীকারবদ্ধ)। এই রাজনৈতিক বার্তাটা পরবর্তী সময়ে সরকার গঠনের পর কোন প্রক্রিয়ায় রয়েছে, সেটা দেখার বিষয়। সেখানে আমরা দুর্নীতি দেখেছি (গবেষণায়) শুধু ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের গবেষণা ছিল কেবল দুর্নীতি নিয়ে নয়, ব্যবসায়ে প্রতিবন্ধকতা কী কারণে হতে পারে তা নিয়ে। কিন্তু সেখানে ছোট-বড় সব শ্রেণির ব্যবসায়ী বলছেন, দুর্নীতি ব্যবসার ক্ষেত্রে এখনো বড় বাধা হয়ে আছে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দুর্নীতি এখনো এক নম্বরেই রয়েছে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক খান আমাদের সময়কে বলেন, আমাদের সরকার সব সময় ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে’ আছে। এর প্রমাণ আমরা দলের ভেতর, মন্ত্রিসভায়, এমনকি দলের কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি কখনও কখনও তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি’ আগে ছিল, এখনো আছে, আগামীতেও থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে কারও কারও বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে পত্রিকায় নাম এসেছে, কিন্তু কেউ প্রমাণ করতে পারেনি। একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিডিয়াতে নাম এলেই তো তার বিরুদ্ধে প্রমাণ ছাড়া ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
দেশে দুর্নীতি কমেছে বলে দাবি করে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘এর প্রমাণ হচ্ছে ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বিএনপির সময় আমরা দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। এখন আমরা ১২/১৩ নম্বরে গিয়েছি। এটাও ভালো না, আরও ভালো হতে হবে। সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে আমরা দুর্নীতি কমিয়ে আনতে আইনানুগ ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কখনও কখনও দুর্নীতি নিয়ে আমাদের ওপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছে। এর বড় উদাহরণ হচ্ছে- পদ্মা সেতু নিয়ে। কিন্তু কানাডার আদালতে এটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।’