বাংলাদেশে বহুল আলোচিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কয়লা সঙ্কটের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। কয়লা আমদানি জন্য ডলার সঙ্কট তৈরি হওয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্মকর্তারা।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ডলারের যে তীব্র সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা এখন প্রভাবিত করছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে। এমন প্রেক্ষাপটে শীতকালেও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে।
শীতকালে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক কম থাকার পরেও যদি লোডশেডিং হয়, তাহলে গ্রীষ্মকালে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে তা ভেবে অনেকে উদ্বিগ্ন হচ্ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ইন্দোনেশিয়া থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশে আসতে পারে। তখন বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে তারা আশা করছেন।
সঙ্কট কতটা গভীর?
রামপালে কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে দু’টি ইউনিটের মধ্যে একটি ইউনিটে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছিল। আরেকটি ইউনিটের নির্মাণকাজ এখনো চলছে।
এখানকার বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় ঢাকা ও খুলনায়। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে আসার এক মাসের কম সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেল।
বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া পার্টনারশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আকরাম উল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ডলারের সঙ্কটের জন্য কয়লা আনা যাচ্ছিল না। যার কারণে উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে।
ডলারের সঙ্কট থাকায় কয়লার দাম পরিশোধ করা যাচ্ছিল না। ফলে কয়লা আনতে সমস্যা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ডলার সঙ্কটের জন্য লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলা নিয়ে জটিলতা হওয়ায় কয়লা আনতে বিঘ্নিত হয়েছিল।
যে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পর সেখানে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। পরীক্ষামূলক উৎপাদনের জন্য রামপালে কয়লা আনা হয়েছিল। তা দিয়ে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করা হয়।
তবে ডলার সঙ্কট কেন হয়েছিল ওই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাৎক্ষনিকভাবে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কয়লা কতদূর?
বিআইএফপিসিএল ও বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়ার সেল দু’টি প্রতিষ্ঠানই জানিয়েছে যে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সঙ্কটের পর তা সমাধানে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে ও যে পেমেন্টগুলো বাকি ছিল সেগুলো দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিআইএফপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আকরাম উল্লাহ।
একই কথা জানিয়েছেন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন। তিনি বলেন, এলসির বিষয়গুলো নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। কয়লা আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
তিনি আরো জানান, ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা জাহাজে তোলা হয়েছে। তবে এগুলো দেশে পৌঁছাতে আরো ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগতে পারে।
গরমে কী অবস্থা হবে?
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ১৭ জানুয়ারি সারাদেশে দিনে সর্বোচ্চ নয় হাজার মেয়াওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। আর সন্ধ্যায় এই চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল সর্বোচ্চ ১০ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে।
বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে এক হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি আছে। এ জন্য ঢাকা শহরে গত কয়েক দিন ধরেই লোডশেডিংয়ে পড়তে হচ্ছে বাসিন্দাদের।
তবে পাওয়ার সেল বিভাগের মহাপরিচালক দাবি করছেন, বিদ্যুতের এই ঘাটতি একেবারেই সাময়িক। তার মতে, বিডিপিবি হয়তো প্রস্তুতই ছিল না যে রামপালের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ফার্নেস অয়েল ও গ্যাস রয়েছে। এগুলো ব্যবহার করেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা রয়েছে বাংলাদেশের হাতে। এটাকে বিবেচনা করে ভবিষ্যতে আশঙ্কার কোনো কারণ নাই।
গরমকালে বিদ্যুতের ব্যবহার আরো বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে মার্চ মাসে গরমকাল হওয়ায় এমনিতেই বিদ্যুতের চাহিদা বেশি থাকে। আবার মার্চ মাসেই রমজান শুরু, এছাড়া সেচ প্রকল্পের কারণেও বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেশি বেড়ে যাবে।
একই সাথে ডলারের সঙ্কটও রয়েছে। এই সঙ্কট নিরসনে আপাতত কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য তেল ও কয়লা আমদানি করতে বাংলাদেশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতবছর সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে সঙ্কট সামাল দেয়ার জন্য লোডশেডিং করতেই হবে।
এবার গরমকালে লোডশেডিং কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিয়ে এখন অনেকেই চিন্তা করছে।
পাওয়ার সেল বলছে, মার্চ মাসে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত দাঁড়াতে পারে। এই চাহিদা পূরণের জন্য গ্যাস, কয়লা ও অন্য উৎস থেকে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে তা হিসাব করে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানিয়ে সরকারি এই সংস্থাটি।
পাওয়ার সেল বিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘এটা আমরা কিভাবে জেনারেট করবো, গ্যাস থেকে কত নেব, কয়লা থেকে কত নেব, লিকুইড থেকে কত পাব, সেটা আমরা একটা ওয়ার্কআউট অলরেডি করে রাখছি।’
রামপাল নিয়ে বিতর্ক
বাংলাদেশে যেসব প্রকল্প নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র তাদের মধ্যে অন্যতম। পরিবেশবাদীরা বলেছিলেন, সুন্দরবনের কাছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হওয়ায় সেখানকার জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।
কিন্তু নানা প্রতিবাদ ও সমালোচনা উপেক্ষা করে সরকার এ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যায়।
২০১০ সালে ভূমি অধিগ্রহণ শুরুর পর ২০১২ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ ৮৯.৫৮ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। পুরো প্রকল্পটি নির্মাণে ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি