শেষ করার সময়সীমা থাকলেও বছরের পর বছর বিলম্ব হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অনেক প্রকল্প। দফায় দফায় এসব প্রকল্পের বরাদ্দ ও মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। এমনকি চার বছরের অনেক প্রকল্প, এক যুগে গিয়েও ঠেকেছে। কিন্তু ফল নেই। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতনভাতাসহ আনুষঙ্গিক বিপুল ব্যয়ের কারণে সরকারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকল্পগুলো। তাই দীর্ঘ সময় ধরে ভৌত অগ্রগতি শূন্য বা বাস্তব অগ্রগতি হচ্ছে না- এমন প্রকল্প অসমাপ্ত রেখেই সমাপ্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এ ধরনের প্রকল্প চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছে। সম্প্রতি সরকারের ২০২২-২৩ অর্থবছরের এডিপিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের চলমান প্রকল্পের অগ্রগতি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পরিকল্পনা কমিশনসূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ দিন ধরে অনেক প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন, অফিস ভাড়া, বিদ্যুৎ বিলসহ নানা ধরনের খরচ চলমান রয়েছে। এর ফলে সরকারের ব্যয়ের পাল্লা ভারী হচ্ছে। এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে এমন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এমনকি অগ্রগতি না থাকলে ৫০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে, এমন প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করা যেতে পারে এমনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সভায় পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, অগ্রগতিহীন প্রকল্পের তালিকা নিজ নিজ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হলে পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পগুলো বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করবে। সভায় প্রকল্প অনুমোদনের পাঁচ দিনের মধ্যে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের পর, পরিকল্পনা কমিশনের চিঠি পাওয়ার একদিনের মধ্যে মন্ত্রণালয় ওই প্রকল্পের প্রশাসনের অনুমোদন দিতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দরপত্র জটিলতা, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা, বৈদেশিক অর্থায়ন জটিলতা ছাড়াও বিভিন্ন কারণে অনেক প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের একটি প্রকল্প সভায় উপস্থাপন করা হয়। প্রকল্পটি হলো বাংলাদেশ রেলওয়ের ৭০টি মিটারগেজ (এমজি) ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ সংগ্রহ। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন দেওয়া হয় এ প্রকল্পের। কিন্তু এক
যুগেও প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি হয়নি। প্রকল্পটির প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় দরপত্রের বিপরীতে দরদাতা পাওয়া যায়নি। পরে দরপত্রের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন পরিবর্তন করে দরপত্র আহ্বান করা হয়।
তৃতীয় দফার দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান হুন্দাই রোটেমের সঙ্গে ২০১৮ সালের অক্টোবরে চুক্তি করে রেলওয়ে। কিন্তু তাদের দাখিল করা ঋণপ্রস্তাব কঠিন বা অনমনীয় হওয়ায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এ ঋণ নিতে রাজি হয়নি। এ বছরের আগস্ট মাসে ঠিকাদারের সঙ্গে ক্রয়চুক্তি বাতিল করে রেলওয়ে। গত সেপ্টেম্বরে প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় প্রকল্পটি বাতিল না করে সরকারি অর্থায়নে অথবা সহজশর্তে বৈদেশিক অর্থায়নে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আবার দরপত্র জটিলতার কারণে অনেক প্রকল্পের অগ্রগতি নেই। এ ধরনের প্রকল্প তালিকা মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাতে বলা হয়েছে। পরে পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করবে বলে জানান পরিকল্পনা বিভাগের সচিব।
জানা গেছে, গাজীপুর থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার শুধু বাস চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট লেনের সড়ক নির্মাণে ২০১২ সালে বিআরটি প্রকল্প অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে গণপরিবহনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা ছিল। ব্যয় ধরা হয় দুই হাজার ৪০ কোটি টাকা, যার মধ্যে প্রকল্প ঋণ এক হাজার ৬৫০ কোটি এবং সরকারের ৩৮৯ কোটি টাকা। কিন্তু প্রকল্পের কাজ আর শেষ হয় না। এখন সময় বাড়ানো হয়েছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কয়েক দফা সংশোধনের পর এ প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে চার হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ২২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। আর সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করা হচ্ছে এক হাজার ২৪৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ট্রাফিকসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য শুধু ট্রাফিক পুলিশ সমাধান নয়, ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়েও কাজ করতে হবে। প্রকল্প এলাকায় ডেসার গ্রোথ সেন্টার ও গার্মেন্টস থাকায় কাজ ধীরগতিতে চলছে। ফলে জনদুর্ভোগ হচ্ছে। রাস্তা ক্রস করার প্রভিশন রাখা হয়নি। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের ময়লার ডিপো অন্য জায়গায় সরানো দরকার।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ জানায়, প্রকল্পটি ২০১২ সাল থেকে চলমান, যার বাস্তব অগ্রগতি ৪৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ। প্রকল্পে পরিচালক পরিবর্তন হয়েছে পাঁচবার। প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধান সমস্যা হচ্ছে- কাজ চলাকালীন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, ইউটিলিটি স্থানান্তরে অতিরিক্ত সময় ব্যয় এবং ঠিকারের অপর্যাপ্ত ক্যাশ ফ্লো।
আলোচনায় অংশ নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের সদস্য (সচিব) সত্যজিৎ কর্মকার বলেন, প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার পর ইউটিলিটি স্থানান্তরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতেই ৮ থেকে ৯ মাস চলে যায়। প্রকল্প অনুমোদনের সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। ট্রাফিকসংক্রান্ত সমস্যার ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করে আগেই কর্মপন্থা নির্ধারণ করে রাখতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘ দিন ধরে বাস্তবায়ন কাজ চললে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ এবং প্রশাসনিক অনুমোদন দিতেও অনেক সময় নেয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সভায় গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট) বাস্তবায়নকালে জনদুর্ভোগের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, সপ্তাহে মাত্র দুদিন প্রকল্পের কাজ করা যায় বলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্ব হচ্ছে। এই প্রকল্প থেকে শিক্ষা নিয়ে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরুর আগেই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিষয়টি চূড়ান্ত করার নির্দেশনা দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন, যাতে প্রকল্প বাস্তবায়নকালে জনদুর্ভোগ না হয়।
এদিকে সভায় অনুমোদন ছাড়া ডেলিগেটেড ওয়ার্ক পরিবর্তন করা হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। কোনো মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের কাজ যদি অন্য কোনো সরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন করে, তাকে ডেলিগেটেড ওয়ার্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন- দেখা যায় স্বাস্থ্য বিভাগ বা কৃষি মন্ত্রণালয়ের কোনো ভবন নির্মাণের কাজ বাস্তবায়নের জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অনেক নির্বাহক এজেন্সি (গণপূর্ত অধিদপ্তর) অর্পিত ক্রয় কার্যের স্থান, নির্মাণসামগ্রী বা ডিজাইন পরিবর্তন করে ফেলে স্বত্বাধিকারী মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অনুমোদন না নিয়ে। এতে উন্নয়ন প্রকল্পের অপচয় বাড়ে। এ কারণে স্বত্বাধিকারী মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অনুমোদন ছাড়া প্রকল্প কাজের কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় হলে সরকারি ক্রয় বিধিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয় পরিকল্পনা কমিশন।