সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাল্যবিবাহের হার এবং একই সাথে অল্পবয়সে গর্ভধারণ। করোনা মহামারীর কারণে গত দুই বছরে এটি আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে।
সরকারি তথ্য বলছে, প্রতি এক হাজারে গর্ভবতী নারীদের মধ্যে ১১৩ জনই কিশোরী। প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন গর্ভবতীর বয়স ১৫ বছরের নিচে। আর প্রতি ৩ জন গর্ভবতীর মধ্যে একজনের বয়স ১৯ এর নিচে। এমন অবস্থায় বাল্যবিয়ের শিকার কিশোরীদের প্রথম সন্তান জন্মদান বিলম্বিতকরণের উদ্যোগ নেয় কেয়ার বাংলাদেশ। দেশে সবচেয়ে বাল্যবিবাহ প্রবণ কুড়িগ্রাম জেলায় ইমাজিন প্রকল্পের আওতায় প্রতিষ্ঠা করা হয় ৬০টি ক্লাব।
যেখানে বিবাহিত ও অবিবাহিত কিশোরীরা যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য অধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, জেন্ডার সচেতনতা বিষয়ে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন আয়মূলক দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণও নিয়েছে। এমনকি নিজের সঙ্গে সে অন্যায় হয়েছে সেটি যেন আর কারো সঙ্গে না হয় সেজন্য বাল্যবিবাহ রোধ করতে ভূমিকাও রাখছে।
সোমবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে কেয়ার বাংলাদেশের ‘ইমাজিন প্রকল্পের’ কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশে বিবাহিত কিশোরী মেয়েদের প্রথম সন্তান জন্মদান দেরীতে নেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কিশোরীদের ভবিষ্যত ক্ষমতায়নের জন্য প্রকল্পটি কাজ শুরু করেছিল। বিবাহিত কিশোরীদের অপরিণত বয়সে সন্তান জন্মদানকে কমিয়ে আনতে সারাদেশেই ইমাজিন প্রকল্পের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন বক্তারা।
ইমাজিন প্রকল্পের প্রোগ্রাম ম্যানেজার লাভলী ইয়াসমিন জেবার উপস্থাপনায় কর্মশালায় আরো বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর (মাতৃ, শিশু ও কিশোর) ড. মো. শামসুল হক, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পরিচালক মো. বেলাল হোসেন শেখ, কেয়ার বাংলাদেশের এক্টিং কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্ক নসব্যাচ প্রমুখ।
কর্মশালায় ইমাজিন প্রকল্পের কিশোরীদের পরিবেশনায় একটি স্পষ্ট-ড্রামার মাধ্যমে প্রচলিত সামাজিক ধ্যান-ধারণাকে তুলে ধরা হয়, একটি বিবাহিত কিশোরীর স্বামীসহ গোটা পরিবারকে কিভাবে সচেতন করে গড়ে তোলে ইমাজিন কিশোরী ক্লাব। এই ক্লাবের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাওয়া উচ্ছাস প্রকাশ করেন অনেকে। কর্মশালায় প্যানেল আলোচনা সঞ্চালনা করেন কেয়ার বাংলাদেশের নারী ও কন্যাশিশু ক্ষমতায়ন কর্মসূচির পরিচালক হুমায়রা আজিজ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ড. মো শামসুল হক বলেন, বাল্যবিবাহ প্রকট আকার ধারণ করছে। এটি থেকে মুক্তি পেতে আরো কার্যকরি পদক্ষেপ নিতে হবে। করোনার টিকার প্রসঙ্গ তিনি বলেন, বাংলাদেশ করোনা মোকাবেলায় কতটা সফল সেটি আর বলার প্রয়োজন নেই। দেশের ৯৮ শতাংশ মানুষ করোনার টিকা পেয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল এমনকি দুর্গম চরে বসবাস করা লোকজনও টিকা পেয়েছেন। অনেকে হিংসা করে বলেন, এখনো ২ শতাংশ বাকি রয়েছে। আমরা দৃঢ় কন্ঠে বলতে চাই, ৯৮ শতাংশ মানুষ নিরাপদ থাকলে বাকি ২ শতাংশ মানুষও করোনা থেকে নিরাপদ থাকবে।
লাভলী ইয়াসমিন জেবা বলেন, সরকারি হিসাবে কুড়িগ্রামে বাল্য বিয়ে ও শিশু মাতৃত্বের হার তুলনামূলক বেশি হওয়ায় জেলাটিতে প্রকল্পটি শুরু করা হয়। অর্থ্যাৎ কোনো কারণে কোনো মেয়ের যদি কিশোরী বয়সে বিয়ে হয়ে যায় তাকে নিয়ে আমরা কাজ শুরু করি। প্রথমে আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল, কিভাবে সমষ্টিগতভাবে আমরা কাজ শুরু করতে পারি। এজন্য ৬০টি ইমাজিন কিশোরী ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে ১৫৭৩ জন কিশোরীকে নিয়ে কাজ করা হয়েছে। যার ৪০ শতাংশই বিবাহিত কিশোরী। ৬৮২ দম্পতিকে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সে কিভাবে স্বনির্ভর হবে, সেজন্য ১০০ বিবাহিত কিশোরীকে আইটি ট্রেনিং দিয়ে ১০০টি ল্যাপটপ দেয়া হয়েছে। ১০০ জনকে মোবাইল সার্ভিসিং ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। ৪০০ জনকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। যেখানে উৎপন্ন পণ্য বিক্রির জন্য দোকানও করে দেয়া হয়েছে।
ইমাজিন প্রকল্পের প্রোগ্রাম ম্যানেজার আরো বলেন, করোনার সময়েও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইমাজিন কিশোরী ক্লাবের সব ধরনের কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এখানে প্রশিক্ষিত কিশোরীরা বাল্যবিবাহ আটকাতেও ভূমিকা রাখছে। ইতিমধ্যে যারা প্রশিক্ষিত হয়ে গেছে এমন ১২০ জন লিডার হিসেবে নিজেদের বাড়িতে কাব পরিচালনা করছে। ফলে এটি টেকসই হিসেবে সামাজিক উন্নয়নে কাজ করবে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের পরিচালক মো. বেলাল হোসেন শেখ বলেন, আমাদের সমাজের বাস্তবচিত্র হচ্ছে কন্যা সন্তান হলে যত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া যায়, ততোই ভালো। শুধু কুড়িগ্রাম নয়, ইমাজিন প্রকল্পের মতো কার্যক্রম সারাদেশেই ছড়িয়ে দেয়া উচিত। এতে বাল্যবিয়ে অনেকটাই কমে আসবে।