‘একবার ঘুরে আসলেই দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। এটা একদিন কিংবা দুদিন মানা যায়। কিন্তু একটানা হলে কি সম্ভব? আমরা তো আর বাড়ি-জমি বিক্রি করে লঞ্চ চালাব না।’ কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি কীর্তনখোলার মালিক মঞ্জুরুল আলম ফেরদৌস।
ঢাকা-বরিশাল নৌপথে লাগাতার যাত্রী সংকটের কারণে চলমান লোকসানের মাত্রা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। কেবল ফেরদৌসই নন, দারুণ হতাশ দক্ষিণাঞ্চলের অন্য লঞ্চ মালিকরাও। লাগাতার যাত্রী সংকটে চোখে অন্ধকার দেখছেন তারা। এরই মধ্যে কমে গেছে বিভিন্ন রুটে চলা লঞ্চের সংখ্যা।
অঘোষিত রোটেশন করেও টেকা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি এমন যে, ব্যবসা পাল্টে ফেলার কথা পর্যন্ত ভাবছেন অনেকে। সেই সঙ্গে ঝুঁকির মুখে পড়েছে এই সেক্টরে বিনিয়োগের হাজার হাজার কোটি টাকা। স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সড়ক পথে এখন মাত্র ৩ ঘণ্টায় ঢাকা-বরিশাল যাতায়াত করতে পারছে মানুষ। বরিশাল অঞ্চলের অন্যান্য গন্তব্যের ক্ষেত্রেও সড়কে যাতায়াতের সময় কমেছে গড়ে আড়াই থেকে ৩ ঘণ্টা। ফলে সড়কপথে যাতায়াতে এসেছে বিপ্লব। এ কারণে যাত্রী সংকটে পড়েছে লঞ্চগুলো।
বরিশাল তথা দক্ষিণের অন্তত ২০টি নৌরুটের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার লঞ্চযাত্রায় এখন কেবলই শূন্যতা। টানা লোকসানের কারণে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে এসব রুটে চলাচলকারী অন্তত ৩০টি লঞ্চ। সেই সঙ্গে চলছে একের পর এক নৌরুট বন্ধের প্রক্রিয়া। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক কম নিয়েও যাত্রী পাচ্ছে না লঞ্চগুলো। পরিস্থিতি এমন যে, প্রায় প্রতি রাউন্ড ট্রিপে আকারভেদে ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত লোকসান দিচ্ছে লঞ্চগুলো। ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী এমভি সুরভী লঞ্চের পরিচালক রেজিন-উল কবির বলেন, ‘প্রায় সব লঞ্চেই শতকরা ৬০ ভাগ কেবিন এবং ৫০ ভাগ ডেক খালি থাকছে।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর লঞ্চের ভাড়া বাড়িয়েছে সরকার। নতুন রেটে ডেকের ভাড়া জনপ্রতি ৪৫৭ টাকা হলেও আমরা নিচ্ছি ৪শ টাকা। এছাড়া সিঙ্গেল ও ডাবল কেবিনে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভাড়ার তুলনায় অনেক কম নিলেও মিলছে না যাত্রী। এক সময় কেবিনের জন্য হাহাকার করা মানুষ যেন এখন ভুলে গেছে লঞ্চের কথা।’
ঢাকা-বরিশাল রুটের লঞ্চ কোম্পানি নিজাম শিপিং লাইন্সের মালিক নিজামউদ্দিন বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ার পর এ খাতে গড়ে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ বেড়েছে। এর সঙ্গে কর্মচারী বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ তো রয়েছেই। রাউন্ড ট্রিপে যদি শতকরা ৭০ ভাগ কেবিন এবং ৬০ ভাগ ডেক পরিপূর্ণ হয় তাহলেও লোকসান এড়িয়ে সমান সমান থাকতে পারি আমরা। কিন্তু এখন তো বলতে গেলে খালি লঞ্চ চালাতে হচ্ছে। প্রতিবার লঞ্চ বরিশাল ঘুরে ঢাকা এলেই হিসাবের খাতায় যোগ হয় লাখ টাকার লোকসান। এভাবে লোকসান দিয়ে তো লঞ্চ চালানো যাবে না।’
ঢাকা-বরিশাল রুটের পারাবত নেভিগেশনের মালিক শহিদুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর মানুষ এখন আর লঞ্চে উঠছে না। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত ২৫ রুটে। এর মধ্যে ঢাকা-বরিশাল রুটেই চলে ২১ লঞ্চ। বাকি ২৪ রুটে গড়ে ২টি করেও যদি ধরা হয় তাহলে আরও ৪৮টি। সাকুল্যে প্রায় এই ৭০টি লঞ্চই এখন লোকসানে। একেকটি লঞ্চ বানাতে যদি ২০ কোটিও ধরা হয় তাহলে ঝুঁকির মুখে পড়েছে বিনিয়োগের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এভাবে চলতে থাকলে লঞ্চ মালিকদের কেবল পথে বসাই নয়, ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে নামতে হবে।’
ঢাকা-বরিশাল নৌরুটসহ দক্ষিণের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর যাত্রী সংকটে বেশি বিপাকে পড়েছে বরিশাল-ঢাকা, পটুয়াখালী-ঢাকা, আমতলী-ঢাকা, ঝালকাঠি-ঢাকা এবং কলাপাড়া-ঢাকা রুটে চলাচলকারী লঞ্চগুলো।
এছাড়া হিজলা, গৌরনদী, হুলারহাট, ভাণ্ডারিয়া, বরগুনাসহ আরও অন্তত ২০টি নৌরুটে মিলছে না যাত্রী। ঢাকা-বরিশাল রুটে দিনের বেলা চলাচল করা ওয়াটার বাস গ্রিনলাইন, অ্যাডভেঞ্চার-৫ আর এমভি টাইপের লঞ্চ রাজারহাট-সি’র চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে আগেই।
বর্তমানে বন্ধ রয়েছে কীর্তনখোলা, সুরভী, সুন্দরবন এবং অ্যাডভেঞ্চার কোম্পানির ১টি এবং পারাবত ও টিপুর ২টি করে লঞ্চ। টানা লোকসান সামাল দিতে না পেরে এসব লঞ্চ বসিয়ে রেখেছে মালিকরা। ঢাকার সঙ্গে ঝালকাঠি ও আমতলী রুটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
কেন্দ্রীয় লঞ্চ মালিক সমিতির সহসভাপতি, বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, ‘করোনায় সড়কপথের যানবাহন চললেও বছরজুড়ে বন্ধ রাখা হয় লঞ্চ। তখনই ১২টা বেজে গেছে আমাদের।
পরে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে লঞ্চ চলাচলের অনুমতি মিললেও বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অনুমতি মেলেনি। এই ধাক্কা সামলে আমরা যখন টিকে থাকার লড়াই করছি ঠিক তখনই এলো পদ্মা সেতু চালুর পর সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ধাক্কা। মানুষ এখন আর লঞ্চে উঠছে না। যা পরিস্থিতি তাতে লঞ্চ ঘাটে বেঁধে রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই।