সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের শেষের দিকে অথবা ২০২৪ সালের প্রথম দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিগত দু’টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান ও নির্বাচন পরবর্তীতে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রথমদিকেই দেশীয়-আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক দেখা দেয়। আন্তর্জাতিক মহলের চাপে থাকা সরকারকে তার ইমেজ-সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে অনেক ঘাম ঝরাতে হয়েছে। আগামীতে সেই বিতর্ক কাটিয়ে উঠতে বিতর্কমুক্ত একটি জাতীয় নির্বাচন করতে চায় সরকার। সে ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন করার জন্য এখন থেকেই জোরালোভাবে চিন্তাভাবনা করছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ।
মনে করা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করা সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনপদ্ধতিতে বর্তমান সরকারপ্রধানই নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে থাকছেন। এ বিষয়টি নিয়ে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ঘোর আপত্তি রয়েছে। আর বিএনপির অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের ওপর চাপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতি ঠিক রেখে আগামী নির্বাচনে বিএনপিকে কিভাবে আনা যায় সে বিষয়ে এখন থেকেই কর্মকৌশল ঠিক করছেন দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের কোনো বার্তা এখনো দেয়নি সরকারি দল।
ধারণা করা হচ্ছে, এ বছরের ডিসেম্বরে সরকারি দল আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সুষ্ঠুভাবে ওই সম্মেলন অনুষ্ঠানের পরই আগামী বছরের প্রথম দিকে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে দৃশ্যমান কার্যক্রম শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন থেকেই বিএনপিসহ অন্যান্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়েও আনুষ্ঠানিক আলাপ আলোচনার বিষয় আসতে পারে। অবশ্য সম্প্রতি বিভিন্ন সভা সমাবেশে চলমান সঙ্কট নিরসন করে বিএনপিসহ নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানোর জন্য সমঝোতার একটি আভাসও দিয়ে রেখেছেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ।
এ প্রসঙ্গে গতকাল এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ কখনো ফাঁকা মাঠে গোল দিতে চায় না। আমরা চাই সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন চায় না, চায় সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন।
নির্বাচনকালীন সরকারপ্রশ্নে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে, সরকারের অধীনে নয়। নির্বাচন কমিশন যদি নিরপেক্ষ হয় তাহলে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। এখানে সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। নির্বাচনকালীন সরকার শুধু নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম নয়া দিগন্তকে বলেন, বিএনপি যতই মুখে মুখে নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলুক তারা ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা আশা করি, আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে। তিনি বলেন, কোনো চাপের মুখে আমরা বিএনপিকে নির্বাচনে আসার জন্য বলছি না। আমরা আগামী নির্বাচন বিএনপিসহ সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন চাই। সেই নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করবে ইনশাআল্লাহ। সমঝোতা বা ছাড়ের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আপনারা জানেন, ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি নেত্রীকে টেলিফোন করে সংলাপের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমরা চেষ্টা করব, বিএনপিসহ সব দলকে আগামী নির্বাচনে আনার জন্য। এখানে ছাড়ের বিষয় নয়। বিএনপি দেশের একটা বড় দল। তারা নির্বাচনে আসুক, একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হবে এটা আমরা চাই। সে কারণে বলছি, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বিএনপির রাজনৈতিক অধিকার। এটা কোনো সুযোগ না, সুযোগ বিতরণ করা হয়, অধিকার বিতরণ করা হয় না।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপরই ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের পর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ সরকারব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে তখন থেকেই আন্দোলনে নামে বিএনপি ও তার মিত্ররা। কিন্তু আন্দোলনের মধ্যেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে ওই নির্বাচনে বিএনপি ও তার মিত্ররা অংশ নেয়নি। অবশ্য বিএনপিকে নির্বাচনে নেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নানাভাবে চেষ্টা-তদবির করেছিল। রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে টানটান উত্তেজনার মধ্যেই ২০১৩ সালের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে সংলাপের প্রস্তাব দেন। যদিও সে সংলাপ আলোর মুখ দেখেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দেশী-বিদেশী চাপে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে আওয়ামী লীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মধ্যে গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকেও বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য আওয়ামী লীগ বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু সমঝোতা না হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি ও তার মিত্ররা। অবশ্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে অনড় থাকা বিএনপি কিছুটা নমনীয় নীতি গ্রহণ করে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
যদিও কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচনের দিন দুপুরের আগেই ভোট বর্জন করে বিএনপি ও তার মিত্ররা। আবার শুরু হয় বিএনপির নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে আন্দোলন। সেই আন্দোলনের তীব্রতা এত দিন মাঠে না গড়ালেও নতুন করে রোডম্যাপ ঘোষণা করতে যাচ্ছে বিএনপি। আর সরকারি দল আওয়ামী লীগ চাইছে, আন্দোলনের হুমকিধমকি না দিয়ে বিএনপি আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিক। আন্তর্জাতিক নানা চাপে থাকা আওয়ামী লীগ বিগত দু’টি নির্বাচনের বিতর্ক কাটিয়ে উঠতে একটি গ্রহণযোগ্য, অবাধ, সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে।