বুধবার, ০১:৪৩ অপরাহ্ন, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

মাতৃভাষার গুরুত্ব

ড. মো: কামরুজ্জামান
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
  • ১২৬ বার পঠিত

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একটি অংশ মনে করেন, মহাবিশ্বের বয়স এক হাজার ৩৮০ কোটি বছর। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ফিলিপস মনে করেন, পৃথিবীর বয়স ৯.৬ কোটি বছর। গার্ডিয়ানের গবেষকরা বলেছেন, পৃথিবীতে ৪১০ কোটি বছর আগে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল। বিবর্তনবাদীদের মতে, আধুনিক মানুষ সৃষ্টি হয়েছে আজ থেকে ৫০ হাজার বছর আগে। তাদের কারো কারো মতে, চার লাখ বছর আগেও পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব ছিল। ভাষা বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাণী সৃষ্টির শুরু থেকেই বিশ্বে ভাষা সৃষ্টি হয়েছে। আধুনিক গবেষকদের মতে, ৮০ লাখ বছর আগে ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। ইহুদি, খ্রিষ্টান ও মুসলিম গবেষকদের মতে, পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম আ:। সৃষ্টির শুরুতে সব প্রাণীর ওপর আদম আ:-এর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ছিল। আর আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সব জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন। এ জ্ঞানের আলোকে তিনি বিভিন্ন প্রাণীর নামকরণ করেছেন। এটি ছিল আদম আ:-এর ভাষাজ্ঞানের বড় প্রায়োগিক প্রমাণ। ভাষা বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাষাজ্ঞানের লিখিত নিদর্শন মেলে আজ থেকে ঠিক পাঁচ হাজার বছর আগে থেকে। মুসলিম গবেষকদের মতে, পৃথিবীর প্রাচীন ভাষা ছিল আরবি। ইসলামের প্রথম মানব আদম আ:-এর জান্নাতে বসবাসের সময় তাঁর ভাষা ছিল আরবি। ইসলামী গবেষকদের মতে, আদম আ: থেকে নুহ আ: পর্যন্ত পৃথিবীর সব মানুষই আরবিতেই কথা বলত। এ দীর্ঘ সময় ধরে সব মানুষ একই শব্দ ব্যবহার করত (বাইবেল, আদিপুস্তক, ১১/১)।

আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি রহ: বলেন, সব আসমানি গ্রন্থ আরবি ভাষায় নাজিল হয়েছিল। নবীগণ আসমানি গ্রন্থগুলো তাদের নিজ জাতির মাতৃভাষায় অনুবাদ করে শিক্ষা দিয়েছিলেন। যুগের চাহিদা মোতাবেক একে একে সব কিতাব রহিত হয়ে যায়। শুধু আসমানি কিতাব আল-কুরআন হুবহু আরবিতেই বহাল রয়ে যায়। (আল ইতকান ফি উলুমিল কুরআন, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৩৬)। সময়ের ব্যবধানে মানব সৃষ্টির পরিবর্তন ঘটেছে; বিবর্তন ঘটেছে মানব সভ্যতার। এ বিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী ভাষাতেও বিচিত্র রূপ ধারণ করেছে। সৃষ্টির শুরুর দিকে মানুষ ইশারা ও অঙ্কনের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করত। সময় বাড়ার সাথে সাথে মানুষ কথা বলার উপায় বের করে। তারা কথা বলার মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান শুরু করে। কিন্তু এ কথা বলার সময় সব ব্যক্তির রীতি ও উচ্চারণ এক রকম হতো না। এক একজনের মুখে ভাষার রীতি একেক রকম দেখা দিত। এতে ভাষা ও তার উচ্চারণ নীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। অর্থাৎ ভাষা উচ্চারণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রীতির উদ্ভব ঘটে। ফলে ভাষাতে বিভিন্ন পরিবর্তন সৃষ্টি হয়। এ পরিবর্তন এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তরিত হতে থাকে। এ স্থানান্তর ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি এবং সম্প্রদায় থেকে সম্প্রদায় পর্যন্ত গড়ায়। শেষ পর্যন্ত দেশ থেকে দেশান্তরে ভাষার এ পরিবর্তন ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে নানা দেশে নানা অঞ্চলে ভাষার উৎপত্তি হতে থাকে।

পরিবর্তিত এ ভাষার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। মানবগোষ্ঠী চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। তাদের মাধ্যমে জন্ম নিতে থাকে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী, দেশ ও মহাদেশ। ফলে ভাষাতে সৃষ্টি হয় ব্যাপক বৈচিত্র্য। বর্তমানে পৃথিবীতে দুই শতাধিক রাষ্ট্র রয়েছে। আর মানুষ রয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি। এ ৮০০ কোটি মানুষ কমবেশি প্রায় আট হাজার ভাষায় কথা বলে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মধ্যে ২৩টি প্রধান ভাষায় বেশির ভাগ মানুষ কথা বলে। আর এ ভাষাভাষী মানুষের দিক থেকে পৃথিবীতে চীনা ভাষার অবস্থান প্রথম। এ ভাষায় পৃথিবীর প্রায় ১২৮ কোটি মানুষ কথা বলে। দুই নম্বরে অবস্থান করছে স্পেনীয় ভাষা। স্পেনীয় ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪৪ কোটি। তিন নম্বরে রয়েছে ইংরেজি ভাষা। পৃথিবীতে এ ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৮ কোটি। আরবি ভাষার অবস্থান চতুর্থ। পৃথিবীতে এ ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা ৩৫ কোটি। এর পরই রয়েছে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার অবস্থান। পৃথিবীতে এ ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৯ কোটি।

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। আর মাতৃভাষার মানেই হলো মায়ের ভাষা। মায়ের ভাষাতে কথা বলা মানুষের চিরায়ত সহজাত প্রবৃত্তি। কারণ, এ ভাষায় মানুষ খুব সহজেই তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। মাতৃভাষা আল্লাহর এক অপার অনুগ্রহ। কারণ, আল্লাহ তায়ালা সব নবীকে স্বজাতির ভাষাভাষী করে প্রেরণ করেছিলেন। (সূরা ইবরাহিম-৪) এ আয়াতটি মাতৃভাষা শিক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য বিশেষ গুরুত্ব নির্দেশ করে। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তিনিই আল্লাহ যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর মনের ভাব প্রকাশ করতে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সূরা আর রহমান : ৩-৪) ভাষাশিক্ষা ও উচ্চারণের অন্যতম অনুষঙ্গ হলো শুদ্ধভাবে উচ্চারণ, লিখন ও পঠন। প্রতিটি ভাষা শুদ্ধ উচ্চারণের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ ছাড়া অর্থ বিশুদ্ধ হয় না। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ‘আইএলটিএস’ কোর্সটি ইংরেজি ভাষা শিক্ষার অন্যতম উদাহরণ। ভাষার বিশুদ্ধ উচ্চারণ ও ব্যবহারের ব্যাপারে ইসলামও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। শুদ্ধ উচ্চারণ ও প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলার ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনা স্পষ্ট। আব্দুল মালেক বিন মারওয়ান বলেন, ‘ভাষা ও শব্দের অশুদ্ধ উচ্চারণ কাপড়ের ছিদ্র ও মুখে গুটিবসন্তের দাগের মতো।’ (আল-আদাবুস সুলতানিয়্যাহ, ১/৪৫) ইমাম জহুরি বলেন, ‘বিশুদ্ধ ভাষা আভিজাত্যপূর্ণ।’ মহানবী মুহাম্মদ সা: ছিলেন আরবের সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জলভাষী। তিনি মাতৃভাষায় কথা বলতে গর্ববোধ করতেন। মহানবী সা: বলেছেন, ‘আরবদের মাঝে আমার ভাষা সর্বাধিক স্পষ্ট। তোমাদের চেয়ে আমার ভাষা অধিকতর মার্জিত ও সুস্পষ্ট।’ (ইবনুল আরাবি) নবীজী সা: আরো বলেছেন, আরবের সবচেয়ে মার্জিত ভাষার অধিকারী সাদিয়া গোত্র। আর আমি সেই গোত্রেই বড় হয়েছি। তাদেরই কোলে আমার মুখ ফুটেছে। তাদের মধ্যে আমি সর্বাধিক সুভাষিত ভাষা ব্যক্ত করেছি। নবীজী সা:-এর এ বক্তব্য মাতৃভাষায় পারদর্শী হওয়া এবং যোগ্যতা অর্জন করার বিষয়ে সাক্ষ্য বহন করে। সুতরাং, এ যোগ্যতা অর্জন করা, মহানবী সা:-এর যোগ্যতারই অংশবিশেষ। ইসলামে ভাষা বিকৃতি সমর্থনযোগ্য নয়। ভাষা বিকৃতি ও অশুদ্ধ উচ্চারণ ইসলামে নিষিদ্ধ। উচ্চারণে বিকৃতি হওয়া থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়ার দোয়া খোদ কুরআনেই উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘হে আমার রব! তুমি আমার ভাষার জড়তা দূর করে দাও! যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।’ (সূরা ত্বহা, আয়াত : ২৭- ২৮) ভাষাজ্ঞান মূলত আল্লাহর ইচ্ছাকৃত সৃষ্টি। কেননা, তিনি আদম আ:-কে সব কিছুর নাম শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি ভাষাজ্ঞানও শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আর তিনি আদমকে যাবতীয় জিনিসের নাম শিক্ষা দিলেন। আর সেগুলো তিনি ফেরেশতাদের সম্মুখে প্রকাশ করলেন এবং বললেন, এ সমুদয় জিনিসের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ (সূরা আল বাকারা : ৩০-৩৩) সমুদয় শব্দ দ্বারা এখানে পৃথিবীর সব ভাষাকে বোঝানো হয়েছে। আর এ ভাষাজ্ঞান দিয়ে আদম আ: পৃথিবীর সব বস্তুর নামকরণ করেছিলেন। পৃথিবীর দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান; সব কিছুর নাম তিনিই রেখেছিলেন।

উল্লিখিত আয়াত ও হাদিসে এটিই প্রমাণিত হয়, ইসলামে মাতৃভাষার ব্যবহার, শিখন ও পঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামে এটি মানুষের জন্মগত অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। এটি সংরক্ষণের জন্য সংঘটিত যেকোনো আন্দোলনই স্বাধিকার আদায়ের শামিল। আর এ স্বাধিকার আন্দোলন করতে গিয়ে যদি কারো মৃত্যু হয়, তিনি শাহাদাতের মর্যাদা পাবেন।

এ সম্পর্কে হাদিসের সুস্পষ্ট বক্তব্য নিম্ন রূপ-‘কোনো নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিত মুসলিম যদি নিজের অধিকার আদায়ে যুদ্ধ করেন; আর এ যুদ্ধ করতে গিয়ে যদি তিনি নিহত হন, তাহলে তিনি শহীদ।’ (আল মুসনাদ, খণ্ড-১২, হাদিস নং-১৪৬)। এ আলোচনা আরো প্রমাণ করে, বিশ্বময় ভাষা বৈচিত্র্যকে ইসলাম স্বীকৃতি প্রদান করে। কারণ, এটি মানুষের হাতে গড়া নয়। এটি আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত এক অপার নিদর্শন। আর এ নিদর্শনের মধ্যে বিশ্ববাসীর জন্য রয়েছে অনেক শিক্ষা।’ (সূরা রুম-২২) ‘পৃথিবীতে আমি যত নবী ও রাসূল পাঠিয়েছি তাদের প্রত্যেককে আমি স্বজাতির ভাষাভাষী হিসেবে পাঠিয়েছি। যাতে তারা তাদের মধ্যে সহজেই দাওয়াত পৌঁছে দিতে পারে।’ (সূরা ইবরাহিম-৪) এ আয়াতদ্বয় পৃথিবীর সব ভাষাকে স্বীকৃতি প্রদানের বড় নির্দেশক। সুতরাং বলাই বাহুল্য, ইসলাম মাতৃভাষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। মাতৃভাষার অধিকার স্বীকৃতিপূর্বক ভাষাকে নিয়ে কাজ করতে ইসলাম উৎসাহিত করে। নির্দিষ্ট কোনো একক ভাষাকে সীমাবদ্ধ করা ইসলাম সমর্থন করে না। কারণ, ইসলাম সব কালের, সব যুগের ও সব মানুষের জন্য এক কালজয়ী বিধান। (সূরা আল-বাকারা-১৮৫) বিশ্বময় ইসলাম সম্প্রচারের জন্য সব ভাষাকে তাই গুরুত্ব দেয়া উচিত। সব ভাষাতে ইসলামচর্চা হওয়াও বর্তমান সময়ের দাবি। এ লক্ষ্যে প্রতিটি ভাষায় ইসলামী সাহিত্য সম্ভার গড়ে তোলাও সময়ের চরম বাস্তবতা।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com