সোমবার, ০৩:৩৫ পূর্বাহ্ন, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

প্রস্তুতির দুর্বলতায় ঈদযাত্রায় দুর্ভোগ

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০২২
  • ৯০ বার পঠিত

ঈদুল আজহায় ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষের ভোগান্তি ছিল অনেক বেশি। অথচ এর আগের ঈদে স্বস্তিতে বাড়ি ফিরেছিলেন। ঈদুল ফিতরের সময় মানুষের বাড়ি ফেরা স্বস্তিদায়ক করা হয়েছে- এমন দাবি ছিল কর্তৃপক্ষের। তাদের আশ্বাস ছিল- এবারের ঈদযাত্রা আরও আরামদায়ক হবে। কিন্তু ঘটেছে উল্টোটা। পরিবহনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ঈদে দীর্ঘ ছুটি ছিল। তাই মানুষ সময় নিয়ে বাড়ি ফেরে। তারও আগে করোনার কারণে বাড়ি যেতে না পারায় ওই সব ঘরমুখো মানুষ ছুটি নিয়েছিলেন। ফলে রোজার ঈদে অনেকটা আরামেই বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের বিশেষ পদক্ষেপ ছিল এমন নয়। আর এবারের ঈদে ছুটি কম। মাত্র দুদিন সময় পেয়েছিলেন। এত অল্প সময়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের চাপ সামলানোর ক্ষমতা গণপরিবহনের নেই। তাই পরিবহন সংকট ছিল অনেক বেশি। এর জের ধরে ভাড়া বাড়ানো হয় তিনগুণ। কিছু ক্ষেত্রে শহরের বাস দূরপাল্লার রুটে চলাচল করে। রাস্তায় যানজটের বড় কারণ ছিল- এক সঙ্গে অনেক গাড়ির চলাচল। তা ছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলতি পথে অকেজো হয়ে পড়ে ও দুর্ঘটনা ঘটে। এসব কারণে সড়কপথে যানজট হয়েছে। রোজার ঈদে একমুখী গাড়ির চাপ ছিল। অর্থাৎ ঘরমুখো মানুষের ভিড় ছিল। উল্টোপথে রাস্তা ছিল ফাঁকা। এবারের ঈদে কোরবানির পশু আমদানি হয় শহরের বিভিন্ন হাটে। এতে করে আসা-যাওয়া দুদিকেই চাপ
ছিল। বন্যার কারণে কিছু অঞ্চলের রাস্তা খারাপ ছিল। সেটিও দুর্ভোগের কারণ। আরও বড় বিষয়- এবারই প্রথম পদ্মা সেতু হয়ে সড়কপথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ সায়েদাবাদ অঞ্চল দিয়ে ঢাকা ছেড়েছেন। এতে করে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, গুলিস্তানসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ দুর্ভোগে পড়েন। ঢাকা থেকে গাড়ি বের হতেই সময় লেগেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এবারের ঢাকা ছাড়তে চাওয়া গাড়ির চাপ পড়েছে সায়েদাবাদ টার্মিনালে। এ কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট অঞ্চলের মানুষও ভোগান্তিতে পড়েন, যা নিকট অতীতে ঘটেনি। সড়কে দুর্ভোগের আরেকটি কারণ মোটরসাইকেল বন্ধের ঘোষণা। এতে করে মানুষ বাস না পেয়ে বিকল্প পণ্যবাহী গাড়িতে চড়েও ঢাকা ছাড়েন।
তবে ঈদের ছুটি শেষে গতকাল প্রথম কর্মদিবসে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক ছিল। গতকাল সচিবালয়ে তিনি বলেন, ‘একটা রুটে প্রবলেমটা বেশি হয়েছে উত্তর জনপদ। হওয়ার কথা ছিল না। কেননা আমাদের সিক্স লেন রোড অলরেডি হয়ে গেছে। ঈদের ছুটিতে উত্তরবঙ্গের যাতায়াতে শুধু যমুনা সেতুটির ওপরেই ৪৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ব্যবস্থাপনা ত্রুটি না হলে এতগুলো দুর্ঘটনা কেন ঘটবে? পদ্মা সেতুর ব্যাপার হচ্ছে- সেখানে কোনো গাড়ি যদি অ্যাক্সিডেন্ট হয়, সেই গাড়িটা সরানোর জায়গা আছে পাশে কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেতুতে সেই জায়গাটা নেই। সেখানে সামনেরগুলো সরিয়ে গাড়ি সরাতে হয়। অনেকগুলো নষ্ট হয়েছিল, সে কারণে আমরা খুবই চাপের মধ্যে ছিলাম।’
উত্তরের পথে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পরিস্থিতি এবার দুঃসহ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে কাটিয়ে ক্লান্ত হয়েছে লাখো মানুষ। ঢাকা থেকে বগুড়ায় যেতে ৩৫ ঘণ্টায় লাগার ঘটনাও ঘটেছে। পদ্মা সেতু হয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে নির্বিঘœ চলাচল করলেও এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতেই কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ ঈদযাত্রায় এই ভোগান্তির এক কারণ। চলতি বছর ঈদুল ফিতরে আনুমানিক ২০ লাখের মতো মানুষ মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফিরেছে। এবার সে সুযোগ না থাকায় সড়কের পাশাপাশি ট্রেনেও উপচেপড়া যাত্রী দেখা গেছে।
আবার ঈদুল ফিতরে ছুটি ছিল বেশি। ঈদের ছুটির আগে দুদিনের সাপ্তাহিক ছুটি ও মে দিবসের ছুটি মিলিয়ে মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল আগভাগেই। আবার তারও আগে পোশাক কারখানার ছুটি হয়েছিল ধারাবাহিকভাবে। কিন্তু এবার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। সড়কমন্ত্রীর কথাতেও বিষয়টি উঠে আসে। তিনি বলেন, ‘একে তো ঈদের ছুটির পরিমাণ কম ছিল, মাত্র তিন দিন। অন্যদিকে সাভার-আশুলিয়া-চন্দ্রা এলাকার গার্মেন্টসগুলোর ছুটি পর্যায়ক্রমে দেওয়ার কথা বললেও গার্মেন্টস মালিকরা সেই ছুটি দিয়েছেন একদিনেই। এতে করে একসঙ্গে সড়কের ওপর প্রচ- রকম চাপ তৈরি হয়।’
‘বিজিএমইএ-বিকেএমইএকে বারবার অনুরোধ করেছি পর্যায়ক্রমে ছুটি দেওয়ার জন্য। বৃহস্পতি ও শুক্রবার চন্দ্রা-নবীনগর এলাকায় যানজট হয়েছে হঠাৎ করে পোশাক শ্রমিকদের একসঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যেটি পর্যায়ক্রমে করার কথা ছিল। সেটি তারা করেননি বা করতে পারেননি।
মন্ত্রী বলেন, এই ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব শুধু সড়ক পরিবহনের প্রকৌশল বিভাগের ওপরেই বর্তায় না, সামগ্রিকভাবে হাইওয়ে পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসনসহ দায়িত্বশীল সবার ওপরেও বর্তায়। তবে অস্বীকারের উপায় নেই, এই যানজটের পেছনে যে ব্যবস্থাপনা ত্রুটি ছিল।
এবারের অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যতে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাদের বলেন, কিছু অব্যবস্থাপনা তো হয়েছেই, আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাই। অতীতের ভুলগুলো থেকে আগামীর পথকে আরও মসৃণ করতে চাই। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ফলে এবার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ স্বস্তিতে বাড়ি ফিরেছেন- এটি স্বস্তির কারণ ওবায়দুল কাদের। তবে এই পথের যাত্রা আরও মসৃণ হবে বলে মনে করছেন তিনি। বলেন, ‘এখানে একটা অংশ মিসিং রয়েই গেছে সেটি হলো- কালনা সেতু এবং অষ্টম চীন-বাংলা মৈত্রী বেকুটিয়া সেতু। আমরা আশা করছি আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এই দুটি সেতু চালু করতে পারব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি অথবা ভার্চুয়ালি সেতু দুটি উদ্বোধন করবেন।
মন্ত্রী বলেন, ঈদযাত্রায় চট্টগ্রামে যাতায়াতে সেতুর কোনো সমস্যা না থাকলেও এই পথে দুর্বলতা হচ্ছে সড়কগুলো চার লেনের। এতে পরিবহনের চাপ বাড়ার ফলে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।
বিদ্যমান চার লেনের সড়ককে বাড়িয়ে ছয় লেন করে এই সমস্যার সমাধানের পরিকল্পনা নিয়েও কথা বলেন ওবায়দুল কাদের। বলেন, ‘বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি। তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ফোর লেন থেকে সিক্স লেনে উন্নীত করার নির্দেশনা দিয়েছেন। অচিরেই এর কাজ শুরু হবে।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে রাজধানীর যানজট পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলেও মনে করেন মন্ত্রী। বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই ঢাকার মেট্রোরেল চালু করা হবে। এ ছাড়া গাজীপুর অংশের এক্সপ্রেসওয়েও আগামী নির্বাচনের আগেই উদ্বোধন হবে।
সড়কমন্ত্রী বলেন, সবার সিদ্ধান্ত ছিল সরকারের পক্ষ থেকে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করা। কিছু কিছু অ্যালাউ করা হয়েছে; আবার কিছু কিছু আদেশ লঙ্ঘন করে হাইওয়েতে এসেছে। আসলে মোটরসাইকেল, যে যানগুলো ছোট ছোট বিশেষত ৩ চাকার; এগুলো নিয়ন্ত্রণ না হলে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
এদিকে সড়কপথের পরিবর্তে যারা ট্রেনে যাবেন বলে নিয়ত করেছিলেন, তারাও চরম দুর্ভোগে পড়েন। ল-ভ- হয়ে যায় ট্রেনের শিডিউল। আবার ট্রেনে বগি না থাকলেও টিকিট বিক্রির জন্য একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছে রেলওয়ে এবং ট্রেনের টিকিট বিক্রির বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সহজডটকম। রেলওয়ে বলছে, সহজডটকমের ভুলেই এমন হয়েছে। অন্যদিকে সহজ দাবি করেছে, তাদের কোনো ভুল হয়নি। অথচ ট্রেনের আসনের অভাবে মানুষ ছাদে বসেও গোটা পথ পাড়ি দিয়েছে। পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে রেলপথে যাত্রীর চাপ অস্বাভাবিক। ট্রেনের বগি লাইনচ্যুতির ঘটনাও অহরহ ঘটছে। দেশের উত্তরের জন্য রেলের বিবেচনায় পশ্চিমাঞ্চলে ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় এখনো কাটেনি। তদবিরে ও কালোবাজারে টিকিট পাওয়া যায়। বঞ্চিত ছিলেন সাধারণ যাত্রীরা, যারা টিকিটের জন্য দিন-রাত স্টেশনে কাটিয়েছেন। তবে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন স্টেশনে গিয়ে বলেছেন, পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো। অন্যবার টিকিট পাওয়া যায় না, এবার দু-একজন মন্ত্রীকে বলেছেন- টিকিট পেয়েছেন।
বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে ঈদে ১ কোটি ১৫ লাখের মতো মানুষ ঢাকা ছাড়ে। ঈদযাত্রায় সড়ক, রেল, নৌপথে ভাড়া ডাকাতি ও ইচ্ছামতো যাত্রী হয়রানির অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি। ঢাকা থেকে তিনটি টার্মিনাল দিয়ে বিভিন্ন জেলায় মানুষ যাতায়াত করে। বিআরটিএর হিসাবে গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী এই তিন টার্মিনাল থেকে ১৭ হাজার ৮৪১টি বাস চলাচলের অনুমোদন আছে। এর বাইরে বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকা হয়ে যায় ৪ হাজার ১৭৯টি বাস। আর ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় চলে আরও ৫৬৫টি বাস। সব মিলিয়ে ঢাকা হয়ে চলাচল করে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার বাস। এসব বাসে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা আছে। ঈদ উপলক্ষে বড় কিছু পরিবহন কোম্পানি অগ্রিম টিকিট বিক্রি করে। সেই টিকিট ছাড়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত একটি চক্র এই টিকিটের একটি অংশ কিনে রাখে বলে অভিযোগ রয়েছে। শেষদিকে তারা চড়া দামে এসব টিকিট কালোবাজারে বিক্রি করে। তবে লঞ্চ পেতে চাপ থাকলেও আগের তুলনায় দুর্ভোগ কম ছিল। এর কারণ পদ্মা সেতু নির্মাণ। মানুষ সড়কপথে দক্ষিণাঞ্চলে গেছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com