শুক্রবার, ০৩:০০ পূর্বাহ্ন, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।
শিরোনাম :

পলাশীর প্রাসঙ্গিকতা

সাইফুল ইসলাম শুভ
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০২২
  • ১৩৭ বার পঠিত

‘কাণ্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর’
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!’
– কবি কাজী নজরুল ইসলাম

আজ ঐতিহাসিক ২৩ জুন। পলাশী ট্র্যাজেডি দিবস। ১৭৫৭ সালের আজকের এই দিনে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর প্রান্তরে, বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার নবাব ‘মনসুর উল মূলক সিরাজউদ্দৌলা মির্জা মোহাম্মদ হয়বত জঙ্গ বাহাদুর’ এক ষড়যন্ত্রমূলক ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায়’ পরাজয়বরণ করলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। যেই স্বাধীনতার সূর্যটি উদিত হয়েছিল ১২০৪ সালে বিখ্যাত মুসলিম বিজেতা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে, সেই সূর্যই সুদীর্ঘ সাড়ে পাঁচ শ’ বছর পরে ১৭৫৭ সালে অস্ত গিয়ে ১৯০ বছর পরে পুনরায় ভোরের সূর্যের মতো উদয় ঘটেছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা যে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অর্থাৎ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ লাভ করেছিলাম তা ছিল ১৯৫৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২১৪ বছরব্যাপী আমাদের পূর্বপুরুষদের অব্যাহত রক্তক্ষয়ী লড়াই-সংগ্রামেরই চূড়ান্ত অর্জন। তাই আজকে প্রায় পৌনে তিন শ’ বছর পরে এসেও পলাশীর চেতনার যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

একটা বিষয় স্মর্তব্য যে, মাত্র ১৭ জন সৈন্য নিয়ে বখতিয়ার খিলজী যখন বর্ণহিন্দু অত্যাচারী রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে রাজধানী নদিয়া জয় করেছিল, সাড়ে পাঁচ শ’ বছর পরে এসে কিন্তু সেই নদিয়ারই ভাগীরথীর স্বচ্ছ পানিতে মুসলিম শাসনের সলিল সমাধি ঘটেছিল। নাহ! ভাগীরথী সেদিন ফোরাতের ন্যায় মুসলমানদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়নি, বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ সেদিন তুচ্ছ নবাবীর লোভে দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। পলাশী ষড়যন্ত্রের মূল হোতা, দরবারের সবচেয়ে প্রভাবশালী অমাত্য ও রাজ্যের সেরা ধনী জগৎশেঠ হলেও ‘চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে’ ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে গঠিত বিশালাকার নবাব বাহিনী, সাকুল্যে সাড়ে তিন হাজার সৈন্যের কোম্পানি বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছিল মূলত প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ’র বিশ্বাসঘাতকতার ফলেই। তাই পলাশী যুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে বিস্তর আলোচনার পাশাপাশি পলাশী-উত্তর সুবিধাভোগীদের নিয়েও পর্যালোচনা করা আবশ্যক। পলাশী-উত্তর বাংলায় মীর জাফর ও তার পরিবার এককভাবে সুবিধাভোগী হলেও পুরো জগৎশেঠ গংয়ের মুসলিম শাসন উচ্ছেদের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন কিন্তু সামগ্রিকভাবেই পূরণ হয়েছিল।

পলাশী যুদ্ধোত্তর বাংলায় চালু হয়েছিল ‘দ্বৈত শাসন’ ব্যবস্থা। দিল্লির মুঘল সম্রাটের ফরমান বলে বাংলার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করেছিল ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি। ফলে মুর্শিদাবাদের নবাবের হাতে থাকে শুধুই শাসনের দায়িত্ব। যার ফলে নবাব পেয়েছিল ক্ষমতাহীন দায়িত্ব অন্য দিকে ইংরেজদের হাতে এসেছিল দায়িত্বহীন ক্ষমতা। অর্থাৎ নবাবের মসনদটি ছিল নিছকই আলঙ্কারিক এক কথায় ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’। স্বয়ং নবাব নিজেই ইংরেজদের প্রদত্ত ভাতায় সংসার ও রাজ্য পরিচালনা করতেন। কোম্পানির অন্যায্য ও জোর করে রাজস্ব আদায়ের ফলে বাংলার সর্বত্র দেখা দিয়েছিল চরম অভাব-অভিযোগ ও অরাজকতা। বাংলার সম্পদ লুণ্ঠন করে মাত্র অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি নিছকই একটি বাণিজ্যিক কোম্পানি থেকে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়। ফলে ১৭৭০ সালের দিকে বাংলায় দেখা দিয়েছিল এক চরম ও সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষ। ইতিহাসে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ খ্যাত এই মহা দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক না খেতে পেরে মারা গিয়েছিল। তারা কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দুদের নিয়ে এক নব্য বাঙালি বাবুশ্রেণী সৃষ্টি করেছিল, যাদের কাজই ছিল শুধু ইংরেজদের বন্দনা গেয়ে কায়েমি স্বার্থ হাসিল করা। আর তাদের হাতেই লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বাংলার সব জমি তুলে দিয়েছিল। ফলে কিছুকাল আগেই রাজত্ব করা বাংলার মুসলমানরা রাতারাতি ভূমিহীন শ্রেণীতে পরিণত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়েছিল।

একটা বিষয় স্মর্তব্য যে, নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব হলেও কিন্তু শেষ নবাব ছিলেন না! পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র ব্যক্তি হলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা যিনি যুদ্ধে হেরে সিংহাসন এমনকি জীবন হারালেও বীরের মর্যাদায় প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী ধুরন্ধর ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ কিন্তু সাথে সাথেই মুর্শিদাবাদের সিংহাসন দখল করেননি কিংবা নবাবের পদটিও বিলুপ্ত করেননি। জনগণকে বোকা বানিয়ে, জনরোষ থেকে বাঁচতে লর্ড ক্লাইভ থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের ইংরেজ শাসকরাও পরম যত্নে ‘নবাবী’ টিকিয়ে রেখেছিলেন, এমনকি ইংরেজরা বিতাড়িত হওয়ার পরও কিন্তু স্বাধীন ভারতে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ‘নবাবী’ বহাল তবিয়তেই ছিল।

এভাবেই, পলাশী যুদ্ধের বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর নিজের ও নিজের পরিবারের রাজক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে ও নবাবীর মসনদ মসৃণ করতেই নিজের দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিতেও কণ্ঠাবোধ করেনি। এই উপমহাদেশেই যুগে যুগে-কালে কালে বিভিন্ন রাজ্যে এ রকম আরো বহু মীর জাফরের জন্ম হয়েছিল এবং এখনো তারা নির্বোধ জাতির মধ্যে স্মরণীয় ও পূজনীয় হয়ে আছেন। যেমন, কাশ্মিরের শেখ আব্দুল্লাহ, সিকিমের লেন্দুপ দর্জি ও হায়দরাবাদের নিজাম বাহিনীর সেনাপতি আল ইদরুস। আর বাংলাদেশের ইতিহাসে কে সিরাজউদ্দৌলা আর কে মীর জাফর তা এখনো জনগণ বোধহয় শনাক্ত করতে পারেনি!!!

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, নবাব সলিমুল্লাহ একাডেমি

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com