পদ্মা সেতুর টোল যোগ করে দূরত্ব অনুযায়ী ১৫টি রুটের বাসভাড়া পুনর্নির্ধারণ করেছে সরকার। ঢাকার ক্ষেত্রে প্রারম্ভিক পয়েন্ট ধরা হয়েছে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালকে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে ৩টি নতুন রুট দক্ষিণাঞ্চল যেতে পারবে পদ্মা সেতু হয়ে। তবে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের টোলের গেজেট প্রকাশ হলে এর সঙ্গে বাড়তি ভাড়া যোগ হবে।
এর আগে গত ৭ জুন ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে ১৩টি রুটে ভাড়া নির্ধারণ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। ওই সময় কিছু দূরত্বের বিষয়ে আপত্তি এলে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) থেকে নতুন করে দূরত্বের তালিকা জোগাড় করে সংস্থাটি। এর সঙ্গে রুট সংশোধন করে ১৫টি রুটের ভাড়ার তালিকা গতকাল চূড়ান্ত করা হয়। টোল যুক্ত করায় আসনপ্রতি ভাড়া বেড়েছে ১০ টাকা।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। ভায়া রুটও পরিবর্তন হয়েছে দু-একটিতে। এক্সপ্রেসওয়ের টোলের গেজেট জারি হলে সেটা যোগ হবে। আপাতত গড়ে ১০ টাকা বেড়েছে। কিছু রুটে ভাড়া কমেছে দূরত্ব কমে যাওয়ার কারণে। ফেরির সঙ্গে সমন্বয় করে পদ্মা সেতুর টোল সংযোজনপূর্বক এই হার নির্ধারণ করা হলো।’
জানা গেছে, ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে বরিশালের দূরত্ব ১৫৬ কিলোমিটার। গাবতলী থেকে পাটুরিয়া হয়ে বরিশালের দূরত্ব ২৪২ কিলোমিটার। আবার সায়েদাবাদ থেকে খুলনা ২৪৭ কিলোমিটার দূরে। গাবতলী থেকে আড়পাড়া হয়ে খুলনা ২৭২ কিলোমিটার। আর ঝিনাইদহ হয়ে ধরলে গাবতলী থেকে খুলনার দূরত্ব ২৯২ কিলোমিটার। তার মানে গাবতলী থেকে দক্ষিণাঞ্চলের রুটের গাড়ি পাটুরিয়ার পরিবর্তে বরিশাল অঞ্চলে পদ্মা সেতু দিয়ে যেতে চাইলে গড়ে দূরত্ব কমবে অন্তত ১০০ কিলোমিটার।
বিআরটিএ নির্ধারিত নতুন রুট হচ্ছে, ঢাকা-বরিশাল ভায়া পদ্মা বহুমুখী সেতু, ভাঙ্গা, মাদারীপুর। এই ১৫৬ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ৪২১ টাকা ২৭ পয়সা। ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জ ভায়া পদ্মা সেতু, ভাঙ্গা পর্যন্ত ১৪৫.৫৩ কিলোমিটারের ভাড়া ৩৯২ টাকা ২৪ পয়সা। ঢাকা থেকে খুলনা ভায়া পদ্মা সেতু, ভাঙ্গা গোপালগঞ্জ ২০৭.১ কিলোমিটারের ভাড়া ৫৩৭ টাকা ২৯ পয়সা। ঢাকা থেকে শরীয়তপুর ভাযা পদ্মা সেতু, ভাঙ্গা, জাজিরা পর্যন্ত ৭৩ কিলোমিটারের ভাড়া ২২৫ টাকা ৭৮ পয়সা। ঢাকা থেকে পিরোজপুর ভায়া পদ্মা সেতু, ভাঙ্গা, বরিশালের জন্য ২০৬ কিলোমিটার দূরত্বের ভাড়া ৫৩২ টাকা ৭৭ পয়সা। ঢাকা থেকে পিরোজপুর ভায়া পদ্মা সেতু, ভাঙ্গা, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট যেতে ২২৭.৫০ কিলোমিটারের ভাড়া ৫৮৩ টাকা ৩৬ পয়সা। ঢাকা থেকে পটুয়াখালী ভায়া পদ্মা সেতু ভাঙ্গা বরিশাল যেতে ১৯২ কিলোমিটারের ভাড়া ৫১৯ টাকা ২৬ পয়সা। ঢাকা থেকে মাদারীপুর ভায়া পদ্মা সেতু, ভাঙ্গা পর্যন্ত ১১১ কিলোমিটারের ভাড়া ৩১৩ টাকা। ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা ভায়া পদ্মা সেতু, ভাঙ্গা, গোপালগঞ্জ, খুলনার জন্য ২৫৭.০৩ কিলোমিটারের ভাড়া ৬৫৪ টাকা।
ঢাকা থেকে ফরিদপুর ভাযা পদ্মা সেতু, ভাঙ্গা পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটারের ভাড়া ২৯২ টাকা ৩৪ পয়সা। ঢাকা থেকে শরীয়তপুর ভায়া বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু, পদ্মা বহুমুখী সেতু পর্যন্ত ৭৩ কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া ২২৫ টাকা ৭৮ পয়সা। ঢাকা থেকে কুয়াকাটা যেতে চাইলে ভায়া পড়বে পদ্মা সেতু, ভাঙ্গা, মাদারীপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালী। এ ২৭৬ কিলোমিটার গন্তব্যের জন্য ভাড়া ৭০১ টাকা ৪ পয়সা। এ ছাড়া কক্সবাজার থেকে বরিশাল যেতে ভায়া চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, ঢাকার পোস্তগলা ব্রিজ, পদ্মা সেতু, ভাঙ্গা, মাদারীপুর পাড়ি দিতে হবে। এ গন্তব্যের দূরত্ব ৫৫৪ কিলোমিটার। ভাড়া ১৩৪৯ টাকা ৫ পয়সা। চট্টগ্রাম থেকে খুলনা যেতে চাইলে ভায়া ফেনী, কুমিল্লা, ঢাকার পোস্তগলা ব্রিজ, পদ্মা সেতু, ভাঙ্গা ও মাদারীপুর পাড়ি দিতে হবে। এ জন্য ভাড়া লাগবে ১১৪৯ টাকা ৬ পয়সা। দূরত্ব ৪৬৯ কিলোমিটার। আর চট্টগ্রাম থেকে বরগুনা যেতে চাইলে ফেনী, কুমিল্লা, ঢাকার পোস্তগলা ব্রিজ, পদ্মা সেতু, ভাঙ্গা, বরিশাল ও পটুয়াখালী পার হতে হবে। এ জন্য ৪৯৫ কিলোমিটারের ভাড়া হবে ১২২৩ টাকা ১৪ পয়সা।
ভাড়া নির্ধারণের হিসাবে দেখা গেছে, ভাড়া নির্ধারণে রুটগুলোয় ৫১ আসনের পরিবর্তে ৪০ আসনবিশিষ্ট বাসভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা থেকে বরিশালের বাসভাড়া নির্ধারণের হিসাব হচ্ছে প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৮০ পয়সা ধরে ৫১ আসনের জন্য ১৫৬ কিলোমিটারের ভাড়া দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৩২০ টাকা ৮০ পয়সা। এই টাকাকে ৪০ আসনে ভাগ করে দাঁড়ায় ৩৫৮ টাকা ২ পয়সা। এর মধ্যে টোলের দুই হাজার টাকার সঙ্গে ৫৩০ টাকা যোগ করলে হয় ২৫৩০ টাকা। এটিকে ৪০ আসনে ভাগ করলে হয় ৬৩.২৫ টাকা। সে হিসাবে টোলসহ আসনপ্রতি ভাড়ার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪২১ টাকা ২৭ পয়সা।
এদিকে গাবতলীর বাস ঢাকা শহর হয়ে চললে যানজট বাড়বে, এই যুক্তিতে গাবতলী টার্মিনাল থেকে চলা বাস পদ্মা সেতু হয়ে চলতে রুট পারমিট পাবে না। গাবতলী টার্মিনাল থেকে চলা দক্ষিণবঙ্গের বাস আরিচা ঘাটের বদলে পদ্মা সেতু হয়ে যেতে চাইলে একই অবস্থায় পড়তে হবে। গতকাল ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সভায় এ নিয়ে বৈঠক হয়। সেখানে বলা হয়েছে, গাবতলী থেকে অনুমতি দিলে শহরের ভেতরে বাস চললে যানজট বাড়বে। তাই দ্রুত শহরের পাশ দিয়ে যাওয়া সড়ক যান চলাচলের উপযোগী করতে বলা হয়েছে। গাবতলী দিয়ে চলা দক্ষিণবঙ্গের ১৯ জেলার বাস সার্ভিস থেকে কিছু কোম্পানি আবেদন করেছে। এ নিয়ে আরটিসির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে।
পরিবহনসংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানী ঘিরে বৃত্তাকার পথ (ইনার সার্কুলার রুট) নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় এ বিপত্তি। এখন মোহাম্মদপুরের বুদ্ধিজীবী সেতুর কেরানীগঞ্জের ভাওয়াল থেকে কলাতিয়া, হযরতপুর-রোহিতপুর সড়ক দিয়ে গাবতলীর গাড়ি এক্সপ্রেসওয়েতে যেতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। আবার সায়েদাবাদ থেকে সব গাড়ির সংকুলান হবে না এমন আলোচনা হয়েছে গতকালের বৈঠকেও। তাহলে ঢাকা-উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গমুখী যানবাহনের রাজধানী এড়িয়ে পদ্মা সেতুতে যাওয়ার পথ নেই। আবার রাজধানীর ভেতর দিয়ে দূরপাল্লার গাড়ি চলাচলের আইনি বৈধতা নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রায় ৬২ হাজার ৫০০ যাত্রী প্রতিদিন ঢাকার উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি নদী পার হয়। যানবাহনের সংখ্যার দিক থেকে বলা যায়, প্রতিদিন ২ হাজার ৯০৯টি যানবাহন পদ্মা পাড়ি দেয়, যার মধ্যে ১ হাজার ২৯৫টি ট্রাক, ৭০০টি হালকা যান এবং ৯১৪টি বাস। পদ্মা সেতু চালু হলে গতি বৃদ্ধির কারণে গাড়ির দৈনিক পরিচালন ব্যয় কমে আসবে। এর ফলে পরিবহনের বছরে মোট সাশ্রয় হবে ৪৩৮ কোটি টাকা। আর ফেরির অপেক্ষার সময় যোগ করলে মোট সাশ্রয় হওয়া সময়ের মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। এখন কোন রুট দিয়ে গাবতলী অঞ্চলের গাড়ি চলবে, তা নির্ধারণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ।