গ্রামের নাম অম্বিকাপুর। পদ্মাপারের ছায়াঢাকা-পাখিডাকা এ গ্রামেই মায়া মমতায় জড়াজড়ি করে ভরে থাকা ছোট্ট একটা বাড়ি কবির। এই গ্রামে যাওয়ার ‘নিমন্ত্রণ’ জানিয়ে কবি নিজেই লিখেছিলেন, ‘তুমি যাবে ভাই—যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়।’
‘‘ওইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে/ তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে’’ এমন শত কবিতা, গল্প, নাটক আর গানের মাধ্যমে পল্লী মানুষের সুখ-দুঃখের কথা তুলে ধরে যে কবি পেয়েছিলেন পল্লী কবির উপাধি।
২এপ্রিল ২০২২ দুই বন্ধু মিলে গিয়েছিলাম অম্বিকাপুর গ্রামে, পল্লীকবি জসীমউদদীনের বাড়ি। এখানেই কবির স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি, কবির কবর।
ফরিদপুর শহর থেকে ১৫/২০মিনিটের পথ বাইক নিয়ে বেশি সময় লাগেনি যেতে। অটোরিকশায় করে গেলে ৩০মিনিটের পথ। ঠিক রাস্তার পাশেই বাড়িটি।
প্রধান ফটক দিয়ে টিকিট কেটে বাইক পার্কিং করে ভেতরে প্রবেশ করলাম। অন্যপাশে বড় খোলা জায়গায় ‘জসীম মঞ্চ’। পাশেই মৃতপ্রায় কুমার নদ। এখানেই প্রতিবছর জানুয়ারিতে কবির জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় ‘জসীম মেলা’। বাড়ির প্রবেশমুখেই কবির কবর। উঁচু বেদীতে চারপাশে নানান রকম ফুলগাছ লাগানো, মাঝখানে কবির কবর।
পাশেই ‘জসীম জাদুঘর’। ২০০৩ সালে ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে কবিপত্নী মমতাজ জসীমউদদীন এ জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন। জাদুঘরের ছোট কক্ষে অনেক কিছু রাখা আছে। জাদুঘরের কক্ষের সামনের দিকেই বড় বড় বর্ণে লিখে টাঙানো কবির লেখা নিমন্ত্রণ, প্রতিদান, আসমানীসহ আরও কয়েকটি কবিতা এবং বেশ কিছু জনপ্রিয় গান। পাশের একটি কক্ষে ২০০৪ সাল থেকে চালু হয় ‘নারী-নকশী কাঁথা কেন্দ্র’। বাড়ির চারদিকে তিনটি টিনের ঘর মাঝে উঠোন। উঠোনের এক কোণে রান্নাঘর। অন্যদিকে ঢেঁকিঘরটি এখনো অক্ষত। চারপাশে নানান গাছ বাড়িটিকে ঘিরে আছে।
এ বাড়িতেই কবি কাটিয়েছেন প্রায় ৩২ বছর। বাড়ির পেছনে ছিল একটি পুকুর। এই পুকুরটিই ভরাট করে নির্মিত হচ্ছে স্মৃতি কমপ্লেক্স। ২০১১ সালে কবি কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ছায়াশীতল পল্লির পরিবেশে আর মৃদু হাওয়ায় গরমের ভয় মুহূর্তেই দূর হয়ে গেছে। প্রতিটি ঘরের সামনে সে ঘর সম্পর্কে লেখা— কবির ঘর, কবির মেজো ভাইয়ের ঘর, ছোট ভাইয়ের ঘর, ইত্যাদি। ঘরে ওঠার সিঁড়িতে ফুলের টব সাজানো। কক্ষগুলোর সামনে কবির বিখ্যাত কবিতার দুই/তিন লাইন করে লেখা। কক্ষের ভেতর শুধু বিখ্যাত কবিতাগুলো নয়, সংরক্ষিত আছে কবির ব্যবহূত নানা আসবাব, বাসন, পোশাক। আলমারিতে রাখা কবির বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ, হাতে লেখা বই, চিঠি, স্মারক ডাকটিকিট। নানা রঙের অসংখ্য পুতুলের ব্যতিক্রমী সংগ্রহ দেখে বিস্মিত হলাম।
কবির বাড়িতে এদিক সেদিকে টাঙানো অনেক স্মৃতিময় আলোকচিত্র। কবি পরিবারের সদস্যদের বাইরেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দিরা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, হেনরি মিলার, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে কবির ছবি শোভা পাচ্ছে চারপাশের দেয়ালে। নানান বয়সের স্মৃতিগুলো ধরে রেখেছে এসব ছবি। বিদেশ ভ্রমণের দুর্লভ ছবিগুলোও রাখা আছে সযত্নে। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে পল্লীকবির একাধিক ছবি দেখলাম। কবির জীবনের শেষ ছবিটিও রাখা আছে দেয়ালে। ১৯৭৫-এর নভেম্বরে পদ্মা নদীতে কবির ছবিটি তোলেন তাঁর ছেলে জামাল আনোয়ার।
কবির লেখা প্রায় সব গ্রন্থই রাখা আছে সংগ্রহে। এছাড়া পুলক দের সম্পাদনায় ‘জসীমউদদীন স্মৃতিকথা সমগ্র’সহ কবিকে নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন নিবন্ধও রাখা হয়েছে সযত্নে। ‘আমার কণ্ঠ’ শিরোনামে দুই পর্বে কবির স্বকণ্ঠে গানের সংকলনও রয়েছে। পল্লীকবির বাড়ি গিয়ে শহরের যান্ত্রিক জীবন থেকে অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য খুঁজে পেলাম বাংলার পল্লি-মমতা।