বুধবার, ০১:৩৫ অপরাহ্ন, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

নির্বাচন পূর্বাপর জাতীয় সরকার

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২২
  • ১২৫ বার পঠিত

রাষ্ট্রব্যবস্থায় জাতীয় সরকারের ধারণা নতুন নয়। কোনো দেশ বা জাতি যখন কোনো গভীর সঙ্কটে নিপতিত হয় তখন সব মত ও পথের নাগরিকদের সর্বসম্মত সমর্থনের প্রয়াসে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কোনো বিশেষ জরুরি অবস্থা, যুদ্ধ কিংবা দুর্যোগ মোকাবেলায় জাতীয় সরকার গঠনের ইতিহাস রয়েছে।

সংসদীয় গণতন্ত্রের পিতৃভূমি ব্রিটেনে স্যার উইনস্টন চার্চিলের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে। জাতীয় সঙ্কট উত্তরণই এই সরকারের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। চরম মুহূর্তে সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সব নাগরিক ঐক্যবদ্ধ হয়। সেখানে ক্ষমতা, স্বার্থ, দ্বন্দ্ব, বিদ্বেষ অতিক্রম করে দেশপ্রেম মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সরকারের ধরন যা-ই হোক না কেন, সব নাগরিককে এক ও অভিন্ন কাতারে একাট্টা করার জন্য জাতীয় সরকারের বিকল্প নেই। অবশ্য জাতীয় সরকার টার্মটি ব্যবহার না করে মূলত জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে ভিন্ন নামে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উদাহরণও রয়েছে। বিভিন্ন দেশের সংবিধানে জরুরি অবস্থা ঘোষণার যে বিধান রয়েছে তাও জাতীয় সরকার ধারণা থেকে উৎসারিত।

এই সাংবিধানিক ধারার অপব্যবহারও রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনী জাতীয় সরকারের প্রতিভ‚ হয়ে দাঁড়ায়। রাজনৈতিক কুশিলবদের বুদ্ধিমত্তা, কৌশল ও পরিকল্পনা জাতীয় সরকার ধারণার অপব্যবহারকে রুখে দিতে পারে। সেখানেও জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নটি মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। কোনো কোনো চতুর রাজনীতিবিদ জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি না করে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের দাবি করতে পারেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ বামধারার ও সুবিধাবাদী দু-একজন রাজনীতিবিদকে ক্যাবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় সরকার গঠনের দাবি করে। কখনো কখনো সামরিক বাহিনী গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করে জাতীয় ঐক্যের দাবিদার হয়ে যায়। রাজনৈতিক অথবা সামরিক উভয় ক্ষেত্রেই মূলত শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় কথিত সরকার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একে বলেন, ‘কোহিজন উইদাউট কনশেনসাস’। অর্থাৎ শক্তি প্রয়োগের অলীক সমঝোতা। সে অবস্থায় মানুষ ভীতির রাজ্যে বসবাস করে। দেশে কবরের শান্তি বিরাজ করে। বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদ জাতীয় ঐক্যের দাবি করেছিলেন। এ ধরনের বিকৃতি সত্ত্বেও জাতীয় সরকারের ধারণা ম্লান হয়ে যায়নি; বরং জাতীয় সঙ্কটময় মুহূর্তে জাতীয় সরকারের ধারণা জনপ্রিয়তা পায়।

বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকারের শক্তি প্রয়োগের নির্মমতা থেকে রাজনৈতিক ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক দলগুলো জোট করার তাগিদ অনুভব করে। সিভিল সোসাইটি নানা ফর্মুলা নিয়ে হাজির হয়। জনগণ ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যের তাগিদ দেয়। জাতীয় সরকারের ধারণাটি অস্পষ্টভাবে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়। বাংলাদেশের শক্তিমান সিভিল সোসাইটির একজন নন্দিত নেতা ডা: জাফরুল্লাহ জাতীয় সরকারের ধারণাটিকে স্পষ্ট করেন। যদিও তার এই ধারণা অন্যদের থেকে পৃথক। তবে স্পিরিট বা চেতনার ক্ষেত্রে তা এক ও অভিন্ন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয় সরকারের ধারণা একটি যৌক্তিক বিষয়। ১৯৭১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫২ বছরে এমন কোনো সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি যেটি জাতির প্রতি সামগ্রিক দায়িত্ববোধ থেকে কাজ করেছে। প্রতিটি সরকার দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কাজ করেছে। ভাবতে অবাক লাগে, ৫০ বছরের একটি জাতীয় আদর্শ, জাতীয় সামরিক নীতি, উন্নয়ন কৌশল, জাতীয় পলিসি এমনকি জাতির পিতৃপুরুষদের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করে না। আজো জাতীয় পরিচিতির বিষয়টি বিতর্কিত। সংবিধান এতই মর্যাদা হারিয়েছে যে, ক্ষমতাসীনরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের নিজ নিজ স্বার্থে ১৭ বার এটি কাটাছেঁড়া করেছে। অবশেষে বর্তমান শাসকদের হাতে সংবিধানটি স্বৈরাচারের কাঠামোতে কেন্দ্রীভ‚ত হয়েছে। যখনই রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি ও জনগণ তাদের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেমেছে তখনই ক্ষমতাসীনরা নির্মম নির্যাতনে ও নিষ্পেষণে আন্দোলনকে প্রতিহত করেছে।

সরকার পরিবর্তনের একমাত্র বৈধ ব্যবস্থা নির্বাচনকে তারা নির্বাসনে পাঠিয়েছে। জনগণের যে স্বাভাবিক সম্মতি তাদের ক্ষমতায় থাকার প্রকৃষ্ট পন্থা তা তারা নিকৃষ্ট শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে স্তব্ধ করেছে। এ দেশের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কখনোই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। সে জন্য সঙ্গতভাবেই নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উত্থাপিত হয়েছে। সেই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই ঐকমত্যকে সম্মান প্রদর্শন পূর্বক বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। লজ্জা, দুঃখ ও ক্ষোভের বিষয়- সেই সময়ের এর সবচেয়ে বড় দাবিদার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর সেই ঐকমত্যের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। বর্তমান সময়ের এই চরম সঙ্কটের একমাত্র কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলকরণ।

২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন ২০১৮ সালের নিশীথ নির্বাচনের পর গোটা জাতি তাদের ওপর আস্থা হারিয়েছে। তাদের অধীনে কোনো নির্বাচনেই যেতে রাজনৈতিক দল ও জনগণ রাজি হচ্ছে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যতীত কোনো নির্বাচন হবে না। এ বিষয়ে এখন জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নয়া দিগন্তে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডান-বাম ও সব ধারার ৪১টি রাজনৈতিক দল নির্বাচন ইস্যুতে অভিন্ন দাবি উত্থাপন করেছে। প্রতিবেদক জানিয়েছেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী ৪১টি রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন দাবির মধ্যে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি এক ও অভিন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার কোন ফরম্যাটে হবে তা নিয়ে দলগুলোর আলাদা আলাদা মত থাকলেও দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে তাদের মনোভাব এক। রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের মতামতের ভিত্তিতে এই মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে।

নির্বাচনপূর্ব সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন শব্দচয়ন রয়েছে। বিএনপি যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রবর্তক, তারা সেই শব্দকেই পছন্দ করছে। তারা নির্বাচনকালীন সরকার বলেও এ ব্যবস্থাকে অভিহিত করছে। অনেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শব্দটি ব্যবহার করছে। ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী জাতীয় সরকারের কথা বলছেন। তার জাতীয় সরকার সময়কাল, সংস্কার প্রয়াস ও জাতীয় উন্নয়ন কৌশল প্রশ্নে ভিন্নতর। তিনি শক্তভাবে বলেছেন, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আকারে-প্রকারে ভিন্নতা থাকলেও নির্বাচন পূর্বকালীন জাতীয় সরকার তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার অথবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার- এক ও অভিন্ন।

জাতীয় সরকার প্রশ্নে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘোষণা এসেছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার পক্ষ থেকে। তিনি নির্বাচন পরবর্তী জাতীয় সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘোষণায় বলা হয়- নির্বাচনে জয়লাভ করলে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব দল ও পক্ষকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠিত হবে। এর লক্ষ্য হলো- জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে সঙ্কটের সমাধান। বিশেষত বিগত প্রায় ১৫ বছরে জাতির যে সর্বনাশ সাধিত হয়েছে তার সমাধানে সব দল ও মতের সমন্বয় সাধন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যেকোনো ব্যাকরণে এটি একটি ‘ইউনিক’ উদ্যোগ। এতে দুই ধরনের সফলতা আসবে- প্রথমত, চলমান আন্দোলনকে তা বেগবান করবে। সবাই আন্দোলনের সফলতা ভোগ করবে। দ্বিতীয়ত, ডাক্তার জাফরুল্লাহ কথিত রাজনৈতিক সংস্কার ও সংবিধান সংশোধনের মতো বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হবে। তার প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন সহজ হবে।

নয়া দিগন্তের অন্য আরেকটি প্রতিবেদনে বিএনপির জাতীয় সরকারের প্রস্তাবে মিত্রদের স্বতঃস্ফ‚র্ত সমর্থনের কথা বলা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ফরিদপুরের মহাসমাবেশে দেয়া বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিএনপির জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়টি পুনঃস্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে কী হবে তা নিয়ে জনমনে অনেক প্রশ্ন। আমাদের নেতা তারেক রহমান স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন- এই সরকারের পতন ঘটিয়ে রাজপথে আন্দোলন করা সব দলকে সাথে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। এই সরকারকে হটাতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আর আগামী নির্বাচন অবশ্যই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে।’ আমীর খসরু মাহমুদের এই স্পষ্ট ঘোষণার পর বিএনপির স্ট্যান্ড নিয়ে আর বিতর্কের অবকাশ থাকে না।

ইতঃপূর্বে ডাক্তার জাফরুল্লাহর প্রস্তাব নিয়ে যে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছিল এই ঘোষণায় তার অবসান হবে। উল্লেখ্য, ডাক্তার জাফরুল্লাহ নিজে বিএনপির জাতীয় সরকার প্রস্তাবনাকে স্বাগত জানিয়েছেন। জনাব চৌধুরী বলেছেন, ‘এটি একটি ভালো কাজ। বিএনপির শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে। তবে আমি বলব, জাতীয় সরকারটি নির্বাচনের আগেও করা যেতে পারে। তাদের অধীনেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে।’ ডাক্তার জাফরুল্লাহর বক্তব্যের পর ভুল বোঝাবুঝির আর কোনো অবকাশ থাকে না বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের প্রত্যাশা। এ দিকে নয়া দিগন্তের রাজনৈতিক বিশ্লেষণে আরো বলা হয়, বিএনপির এই আগাম প্রস্তাব দলটির প্রতি সহযোদ্ধা রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা বাড়াবে। বিএনপি যে কার্যকর যুগপৎ আন্দোলনের কথা বলে আসছে সেটি শক্তিশালী করার জন্যই বিএনপির এই প্রস্তাব। তারা বিএনপির এমন সিদ্ধান্তকে যুগোপযোগী ও সময়োপযোগী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলেও উল্লেখ করেন। এই প্রতিবেদনে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়, বিএনপির যুগপৎ আন্দোলন কৌশল সফলতার দিকে এগোচ্ছে।

বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এই উপসংহারে আসা যায়, নির্বাচনের আগে ও পরে নির্বাচনকালীন সরকার তথা জাতীয় সরকার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের সফলতা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল- দেশে এখন সেই অবস্থা বিরাজ করছে। বাংলাদেশের সর্বত্র যে গণজাগরণের সূচনা হয়েছে তা নির্বাচনকালীন সরকার বা জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠাকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলবে। জনগণের বিজয় সময়ের ব্যাপার মাত্র।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ-জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com