সামিরা তাবাস্সুম বলে ডাকলেন পারিজাত রহমান,
একটা মিষ্টি চেহারার মেয়ে উঠে আসলো, দেখে বয়স বোঝা যায় না, ছোট খাটো গোলগাল, বয়স প্রায় ৪৫ বছর।
বসুন, বলুন আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
জি, আমি একজন পরিচিত ভাবির মাধ্যমে আপনার খোঁজ পেয়েছি, তারপর জিপিকে বলে আপনার কাছে রেফারাল নিয়ে এসেছি…
আচ্ছা বলুন,
আমাদের বিয়ের বয়স ৯ বছর, একটা ছেলে আছে প্রায় ৪ বছরের, এটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে, প্রথম বিয়ের একবছরের আগেই ডিভোর্স হয়ে যায়, সেই হাসব্যান্ড শুধু মারতো, বিয়ের পর থেকেই কিছু হলেই মারতো, নেশা করতো…
টাকা চাইতো, গয়না চাইতো পরে ফ্যামিলি থেকে ছাড়াছাড়ি করিয়ে নেয়, বেশ ক’বছর বাবার বাড়িতেই থেকেছি, আবার পড়াশোনা করে চাকরিতে ঢুকেছি, আরও ৫ বছর পর এই বিয়ে হয়, ফ্যামিলির মতেই তবে আমার টুকটাক জানাশোনা ছিলো…
বিয়ের ১ম বছর ভালোই গেলো, আমরা স্কিল মাইগ্রেসন নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে এলাম বিয়ের দু’বছরের মাথায় ঘটলো বিপত্তি, দ্বিতীয় বছর থেকেই শামীমকে একটু অন্যমনস্ক দেখতাম, বেশি বেশি বাইরে থাকে, ফোনে কথা বলে সারাক্ষণ, কিছু জিজ্ঞাসা করলে এড়িয়ে যায় বা বিরক্ত হয়।
এরপর একদিন টের পেলাম সে ২/৩টা মেয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলে, বাথরুমে গেলে শামীমের মোবাইল ঘেটে দেখি ২/৩ জনের সঙ্গে রীতিমতো প্রেমালাম…
তারপর থেকে মন এত খারাপ হলো, শামীমকে চার্জ করলাম, সে খুবই বিরক্ত হলো এবং তার ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাতে মানা করলো, আমার নাকি সুখে থাকতে ভুতে কিলায়! কিন্তু আমি কিছুতেই এসব মেনে নিতে পারছি না, আমার বোনকে শেয়ার করলাম, সে বাচ্চা নিতে বললো, বলে বাচ্চা হলে ছেলেদের সংসারে মন ফেরে, আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না এর মাঝে বাচ্চা নিবো কিনা…
পারিজাত রহমান বললেন, দেখুন প্রতিটা মানুষ আলাদা, তাদের বেড়ে ওঠা, নৈতিকতা আলাদা, শুধু শুধু ওনার মোবাইল ঘাটতে যেয়ে তো নিজের অশান্তি বাড়িয়েছেন, আর মেয়েদের সঙ্গে কথা বললেই প্রেম হয় না, বন্ধু হতে পারে, কোনো প্রয়োজন হতে পারে, আবার ক্ষেত্রবিশেষে প্রেম ও হতে পারে…
তবে সন্দেহ বিষয়টাই খুব খারাপ, কনফার্ম না হয়ে কাউকে সন্দেহ করা ঠিক না।
শামীম বেশ রাত করে বাড়ি ফেরে, কিছু বললে খুবই মেজাজ দেখায়, কিন্তু সে বাজার এবং সংসারের যাবতীয় খরচ ঠিকমতো করে, আমার যা কিছু প্রয়োজন সেগুলো ও কিনে দেয়, কিছু না বললে ভালোই থাকে, টুকটাক গল্প করে কিন্তু মেয়েদের সাথে চ্যাট বা ফোন কথা বলা, দেখা করে কিনা এসব জিজ্ঞাসা করলেই অশান্তি…
তখন কথা বন্ধ, চিৎকার চেঁচামেচি দুপক্ষ থেকেই
আমি একদিন রাগ করে বললাম, আমি যদি এখন ৩/৪টা ছেলের সঙ্গে ফোনে গল্প করি, চ্যাট করি, দেখা করি, তুমি কি মেনে নিবা?
বলে করো, কে মানা করেছে?
আমার লাইফ এ নাক গলাবা না, আমি তোমার কোনো প্রয়োজন অপূর্ণ রাখিনি, তাদের কেউ আমার বন্ধু, কেউ প্রেমিকা, তারা আছে, থাকবে, তারা আমার মানসিক শান্তির উৎস। তুমি তো আছো সম্পত্তি আর নিজের ভাইবোন নিয়ে, তুমি এসব বুঝবে না।
এর মানে কি বলেন? এ কি রীতিমতো লম্পট নয়?
আচ্ছা আপনাকে মাঝে থামিয়ে আমি দুইটা প্রশ্ন করি,
ওনার বয়স কত এবং ওনার কি প্রথম বিয়ে না দ্বিতীয়?
ওর বয়স আমার মতোই, সমবয়সী আমরা, আর হ্যাঁ এটা তার প্রথম বিয়ে তবে বিয়ের আগেও তার অনেকগুলো প্রেম ছিলো শুনেছি।
আপনাদের দাম্পত্য সম্পর্ক কেমন?
এমনিতে ভালো, কিন্তু সে তার ইচ্ছেমত চলে,
কোনো কথা বলা যায় না, বললেই সমস্যা।
আপনি কি কিছুটা বেশি বৈষয়িক আপনার স্বামীর কথার প্রেক্ষিতে বলছি?
বৈষয়িক কি জানি না, আমি হয়তো বলি বাড়িঘর করতে, দেশের সম্পত্তির ভাগ ঠিকঠাক বুঝে নিতে, শামীম বিরক্ত হয়, আমি কি এগুলো আমার জন্য বলি বলেন?
আমাদের সবার জন্যই তো বলি
আচ্ছা ঠিক আছে বলুন, এরপর?
শামীমকে একদিন বললাম, একটা বাচ্চা নেই আমরা, বললো পালতে পারবে? পালতে পারলে নাও। এখানে তোমার মা বোন বাচ্চা পেলে দেবে না, তোমাকেই পালতে হবে, আমিও ওতো সাহায্য করতে পারবো না যেহেতু আমার চাকরি আছে। বললাম আচ্ছা।
কিছুদিন পর কনসিভ করলাম কিন্ত দুমাসের মাথায়
বাচ্চাটা মিসক্যারেজ হয়ে গেলো, খুব মনখারাপ হলো, শরীর তো খারাপই,
একরাত হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল, শামীম ছিলো আমার সাথেই, তারপর বাসায় আসার পরে দুনিয়ার চেঁচামেচি, আমি নাকি সাবধানী না, ডাক্তারের কথা মানি না, একটা প্রাণ নষ্ট করলাম ইত্যাদি। শামীম আবার আগের মতোই… সে তার কাজ ও মেয়ে বন্ধু প্রেমিকাদের নিয়ে ব্যস্ত।
আচ্ছা, ওনার ছেলে বন্ধু নেই?
জি, আছে… অনেক আছে, সে বন্ধুমহলে খুবই জনপ্রিয়।
আপনার বন্ধু বান্ধবী নেই?
তেমন নেই, ডিভোর্স হওয়ার পর বন্ধু বান্ধবরা দূরে সরে গেলো, যেন আমার সব দোষ। এরপর আর বন্ধু তেমন হয়নি, মা-বোন নিয়েই কেটে যায়।
এরপর?
বাসায় থাকি একা খারাপ লাগা বাড়লো, পরে এইজ কেয়ারের কোর্স করে জবে ঢুকলাম…
সময় যায়, আমি আমার মতো, শামীম তার মতো।
বাসায় যতক্ষণ থাকে সারাক্ষণ মোবাইল বা মুভি দেখে
হঠাৎ একদিন বাসায় আসলে তার মোবাইল আমি লুকিয়ে রাখলাম,
শামীম যখন খুঁজছিলো তখন বললাম লুকিয়ে রেখেছি সকালে দিবো, এখন শুধু আমার সাথে কথা বলবা, গল্প করবা। শামীম এত বিরক্ত হলো যে চিৎকার চেঁচামেচি করে বাসা মাথায় তুললো…
বললো আমি ছোটলোক দেখে এসব ছোটোলোকি কাজ কর্ম করি।
সে বন্ধুদের সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারে না…
এভাবেই পাঁচ বছর গেলো, মা, বোন সবাই বললো বাচ্চা নিতে নয়তো শামীম কখন কোথায় কোন দিকে চলে যায় ঠিক নাই!!
এসব চিন্তায় আমার মাথা ঘোরে, কি করবো বুঝি না
একদিন বললাম আমি তোমার কে হই?
বললো বিয়ে করা বউ, বললাম তাহলে ঐ মেয়ে কে যার সাথে কথা বলো?
সে যেই হোক, তোমার জন্য ক্ষতিকর না, কিন্তু আমার জন্য উপকারী। সবারই ব্যক্তিগত জীবন আছে, বউ মানে এই না যে আমার মগজ ধোলাই করে খাবে, তুমি তোমার মতো থাকো আর ভালো না লাগলে যাকে ভালো লাগে সেখানে যাও, তোমাকে আমি আটকে রাখিনি, খারাপ ব্যবহারও করি না।
আপনার শশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক কেমন?
মোটামুটি, ওপরে ভালো।
আমি বুঝি তারা আমাকে তেমন পছন্দ করে না, যেহেতু আমার আগে একটা বিয়ে হয়েছিল, তাদের ধারণা আমি শামীমকে ট্রাপে ফেলে বিয়ে করেছি, আসলে তা সত্য নয়, শামীম নিজে থেকেই বিয়ে করতে রাজি ছিলো, সে বলতো ডিভোর্স তো আমার দোষে হয়নি, যেই লোক বৌকে মারে তার সাথে সংসার করার দরকার কি?
ডিভোর্স দিয়েছি ভালোই করেছি।
হুম, তারপর?
কেমন যে লাগে ঠিক বোঝাতে পারবো না , একটা জামাই মারধর করতো, ছাড়িয়ে নেওয়ার পরে এই বিয়ে করলাম, শামীমও কেমন যেনো, ভালো আবার ভালো না। এরপর আবার আর একজন হলে সে যে কেমন হবে?
সেই আশঙ্কায় ভাবলাম বাচ্চা নেই, বিয়ের ছয় বছর পরে একটা ছেলে হলো, এখন সাড়ে তিন বছর প্লাস,শামীম বাচ্চার খরচ দায়িত্ব সবই ঠিকমতো পালন করে, আমার সাথেও মোটামুটি ভালো কিন্তু মনোযোগ কম এখন সে নতুন কোন একজনের সাথে গল্প করে। আচ্ছা এখনকার সব ছেলেই কি এমন নাকি শামীম এমন?
: হুম, জটিল প্রশ্ন, আমি তো আর সব ছেলের মনের খবর জানি না, সবার সাথে কথাও বলি না, তাই উত্তর দেওয়া কঠিন। ওনার সম্পর্কগুলো কোন পর্যায়ের তাও বুঝতে পারছি না, শুধু ফোনে কথা বলা, চ্যাট করা এগুলোতেই সীমাবদ্ধ নাকি আরও দূর? দেখা সাক্ষাত, একান্তে সময় কাটানো সবকিছুই সেটা জানতে পারলে ভালো হতো।
: সেসব আমিও জানি না, ওগুলো তো আমাকে বলবে না।
: এবং উনি কি একটা দুইটা মেয়েতেই সীমাবদ্ধ নাকি কয়দিন পর পর বান্ধবী, প্রেমিকা বদলায়?
কয়দিন পর পর বদলালে এটা তার স্বভাব, সহজে যাবে না। একটা দুইটা হলে, কোন ইতিহাস বা গল্প থাকতে পারে পেছনে।
ঠিক জানি না, তবে মনে হয় বদলায়,
আমি কিছু জিজ্ঞাসা করলেই সমস্যা, আমি হয় বেশি বৈষয়িক আর নয়তো বেশি কথা বলি।
এখন মনে হয় বাচ্চা নিয়ে ভুল করলাম, একা হলে সহজে ছেড়ে যেতে পারতাম…
দেখুন বাচ্চা দিয়ে কাউকে আটকানো যায় না, বা সে রকম চিন্তা করে বাচ্চা নেয়াটাও আমি বেশ বড় ভুল বলে মনে করি, মাঝপথে আর একটা জীবনের কষ্ট। ওনার যদি আপনার প্রতি ভালোবাসা, সম্মান না থাকে তাহলে আপনি যতগুলো বাচ্চা নেন কোন লাভ নেই। অনুরূপ ভালোবাসা বিস্বাস আপনারও থাকা উচিত তার প্রতি।
অহেতুক সন্দেহ দাম্পত্য সম্পর্ক নষ্ট করার অন্যতম প্রধান কারণ। তবে প্রমান থাকলে স্ত্রী হিসেবে আপনি তাকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আর প্রথম এবং দ্বিতীয় স্বামী খারাপ হলেই যে তৃতীয়টা খারাপ হবে সেটা ঠিক নয় আবার ভালো হবে সেটাও হলফ করে বলা যায় না। আপনি আগেই এত সংকুচিত হলেন কেন?
না মানে সমাজ কী বলবে? আত্মীয়রা তো বলবে আমিই খারাপ, কোনো বিয়ে টিকে না। এসব চিন্তা, মা বোন ও মানা করে ইত্যাদি ভেবে ভেবে আর আগানো হয় না।
এখন সমাজ কী আপনাকে খাওয়ায়? নাকি আত্মীয়রা আপনার বাচ্চা পেলে দেয়? আর আপনি তো বিয়েই করবেন, যেটা ধর্মীয়ভাবেও স্বীকৃত। লিভ টুগেদার না, তাহলে কে কী ভাবছে এতো ভাবার কী দরকার?
আপনি যদি সমাজ বা মা বোনকে খুশি রাখতে নিজের জীবন বিসর্জন দেন, সেটা আপনার বিবেচনা। আপনি প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষ, নিজের ভালোমন্দ বোঝার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে।
দাম্পত্য জীবন দুর্বিসহ লাগলে এক সাথে না থাকা ভালো, এতে মনের ওপরে চাপ বাড়ে, শরীর খারাপ হয়, মন খিটমিটে হয়ে যায়। আর যদি সবকিছু জেনে মেনে নিতে পারেন, তাহলে থাকবেন।
ঠিক যে মেনে নিতে পারি তা না। খুবই কষ্ট হয়, জিদ লাগে, কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে বলে কোন লাভ নেই, তারা নির্বিকার বরং খানিকটা খুশি মনে হয়।
কারো জীবনের সমস্যার সমাধান কেউ করতে পারে না, ওনারাও করবেন না। আপনার জীবনের সমস্যার সমাধান আপনাকেই করতে হবে।
এখন আমি কী করবো বাচ্চাটা নিয়ে?
এগুলো কি শামিমের উচিত?
দেখুন প্রতিটা মানুষের সীমারেখা, ধারণক্ষমতা আলাদা হয়, কেউ খুব অল্পতেই ভেঙে পড়ে, আবার কেউ অনেক কষ্টেও হাসতে পারে। মিঃ শামীম কে আমি চিনি না কিন্তু যার যেটা স্বভাব একটা বয়সের পর এসে সেটা আর খুব একটা বদলায় না যদি উপরওয়ালা হেদায়েত না করেন। এখন আপনার জীবনের সিদ্ধান্ত আপনাকেই নিতে হবে। পৃথিবীতে সবাই মৃত্যুদিন নির্ধারিত হয়েই জন্মেছে সুতরাং ততদিন পর্যন্ত সবার রিজিক ও বরাদ্দ। কারো জীবন কারো জন্য থেমে যায় না। এত ঝামেলা মনে করেছেন তারপরেও কিন্তু বাচ্চা নিয়েছেন তখন সেই বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়ার সামর্থ্য মা হিসেবে থাকা উচিত। আপনার তো জব আছে, বাচ্চাটা তো আপনারও, ওনার একার না।
মিঃ শামীম কি আসবেন কথা বলতে?
তাহলে কিছু বিষয় স্পষ্ট হতো আমার কাছে…
অনুমান করে কারো সম্পর্কে কিছু বলা ঠিক না।
সামিরা বললো, জানি না আসবে কিনা, বললে যে কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছি না, আসতে চাইলে নিয়ে আসবো।
আচ্ছা আমি কিছুদিন আলাদা থেকে দেখি, কেমন লাগে?
কিন্তু পরে যদি ভালো না লাগে, তখন ফিরতে চাইলে যদি শামীম রাজি না হয়?
পারিজাত রহমান বললেন, ওনাকে তো আপনি ভালো চেনেন। তাহলে আগে পরে চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নেন। স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করুন সবার আগে, এটা খুবই জরুরি।
ঠিক আছে আজ তাহলে আসি, আর একদিন আসবো।
সামিরা তাবাস্সুম চলে গেলেন।
পারিজাত রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবতে বসলেন, কত বিচিত্র মানুষের মন, চলে যেতে চায়, আবার আসার পথও খোলা রাখতে চায়, জীবনে কেউ অনিশ্চয়তা চায় না, ভালোবাসা থাকুক আর না থাকুক, আহারে জীবন।
লেখকঃ শায়লা জাবীন