করোনা মহামারী পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের সেশনজট নিরসনের লক্ষ্যে লস রিকভারি প্ল্যান হাতে নিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই প্ল্যানের আওতায় সেমিস্টারভিত্তিক বিভাগগুলোতে প্রতি সেমিস্টার ছয় মাস থেকে কমিয়ে করা হয়েছে চার মাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞানসহ (কয়েকটি ব্যতীত) প্রায় সব অনুষদ করোনাপরবর্তী সময় থেকে চলছে এই প্ল্যান অনুসারে।
লস রিকভারি প্ল্যান মোতাবেক ছয় মাসের সেমিস্টার সংক্ষিপ্ত করে চার মাস করা হলেও এর সিলেবাস কমানো হয়নি (কিছু বিভাগ ব্যতিক্রম আছে)। যার ফলে ছয় মাসে একজন শিক্ষক একটি কোর্সে ক্লাস-পরীক্ষা নেয়ার জন্য যতটুকু সময় পেতেন এখন তার এক-তৃতীয়াংশ সময় তিনি পাচ্ছেন না। একই সাথে পর্যাপ্ত ক্লাস নিতে না পারলেও শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, মিডটার্ম, সেশনাল-সহ অন্য সব ধরনের পরীক্ষাও নেয়া হচ্ছে ঠিক একই সময়ের মধ্যে।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, একটা সেমিস্টারের কার্যক্রম বাকি থাকতেই পরবর্তী সেমিস্টারের ক্লাসও শুরু হয়ে যাচ্ছে। এক সেমিস্টারের পরীক্ষার ফলাফল না দিয়ে পরবর্তী সেমিস্টারের পরীক্ষা নেয়ার কোনো নিয়ম না থাকলেও সময় স্বল্পতার কারণে দুই সেমিস্টারের ফলাফল একসাথে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। ফলে এক দিকে একটা কোর্সের জন্যে পর্যাপ্ত ক্লাস হচ্ছে না, অন্য দিকে সার্বক্ষণিক ক্লাস-পরীক্ষার চাপ মাথায় নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। লস রিকভারি প্ল্যানের প্রাপ্তি হিসেবে সেশনজট কমলেও গুরুত্ব পাচ্ছে না শিক্ষার্থীদের প্রকৃত পড়াশোনা ও মানসিক চাপের প্রতিকার।
সম্প্রতি ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটি জরিপ প্রকাশ করে। এতে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৪৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট ১৬৪০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন। জরিপের তথ্যমতে, করোনাপরবর্তী সময়ে প্রায় ৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বাজেভাবে অ্যাকাডেমিক চাপের সম্মুখীন।
জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ৪৭ শতাংশ শিক্ষার্থীর করোনার আগের তুলনায় পড়াশুনার প্রতি মনোযোগ কমে গেছে। তাদের ঘন ঘন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে, যার ফলে তারা খাপ খাওয়াতে পারছেন না। পরীক্ষার সময়ের চেয়ে সিলেবাসের আধিক্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও প্রায় ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্বল্প সময়ে এত বড় কোর্স শেষ করার ফলে পড়া বুঝতে ব্যর্থ হওয়ার কথা এবং অধিকাংশ শিক্ষার্থী পড়াশুনার চাপের জন্য পরিবারকে সময় দিতে পারছেন না, যা তাদের মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক চাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে হতাশায় তারা আশঙ্কাজনকভাবে আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। ঢাবির ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বাংলাদেশ মনোবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি ড. মো: মাহমুদুর রহমান বলেন, করোনাপরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কথা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসছে। এর কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা থেকে শুরু করে মানসিক শান্তির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে পড়াশোনার চাপ, পরীক্ষার চাপ, সামাজিকতা, ব্যক্তিগত হতাশার মতো বিষয়। এসব ব্যাপার শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা চেষ্টার পেছনে নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। অনেকসময় তারা সফলও হচ্ছে।
লস রিকভারি প্ল্যান মোতাবেক পড়িয়ে তৃপ্তি পাচ্ছেন না শিক্ষকরাও। কম সময়ে ক্লাসের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দিনের বড় একটা অংশ তাদের শুধু ক্লাসই নিতে হচ্ছে। ফলে গবেষণাধর্মী কাজে তারা পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ক্লাস নিচ্ছি। বেশি ক্লাস নেয়ার ফলে আমাদেরও কাজে কর্মে ক্লান্তি চলে আসছে। বেশি ক্লাস নেয়ার ফলে পরীক্ষার খাতাপত্র দেখতে অনেকসময় দেরি হয়। ফলে পরীক্ষার ফলাফল আসতেও দেরি হচ্ছে।
লস রিকভারি প্ল্যান আরো কতদিন চলবে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, এটা নিয়ে আমরা আগামী অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে আলোচনা করব। সেখানে বিষয়টি নির্ধারণ করা হবে। আমরা যে কারণে এই প্ল্যানটি করেছিলাম আমার মনে হয় সেশনজট আমরা বহুলাংশে কমিয়ে নিয়ে এসেছি।
শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক চাপের ব্যাপারে তিনি বলেন, চাপের বিষয়টি আমরাও জানি, শিক্ষার্থীদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বিষয়টা আমরা শুনেছি যে, শিক্ষকদেরও অনেক সমস্যা হচ্ছে। তাদের খাতা দেখতে সমস্যা হচ্ছে। আমরা আশা করি, আগামী বছরের শুরুর দিক থেকে আমরা স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম শুরু করতে পারব।