রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশে জ্বালানি সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করছে। এক দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। অন্য দিকে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে জ্বালানি তেল আমদানি। সব মিলেই কাক্সিক্ষত জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে ভর্তুকি কমানো ও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে জ্বালানি ব্যবহার কমানোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে আজ থেকে এক সপ্তাহ এলাকাভেদে প্রতিদিন এক ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হবে। এতেও ঘাটতির সমন্বয় না হলে আগামী সপ্তাহ থেকে দুই ঘণ্টা করে বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হবে। মসজিদসহ সব উপাসনালয়ে নামাজ ও প্রার্থনার সময় বাদে এসি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৮টার পর দোকানপাট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর বাইরে জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য প্রতি সপ্তাহে এক দিন পেট্রলপাম্প বন্ধ রাখা যায় কি না সে বিষয়ে প্রক্রিয়া চলছে। ইতোমধ্যে পেট্রোবাংলাকে এ বিষয়ে পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাথে বৈঠক করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি অফিস কর্মঘণ্টা কমানোর বিষয় পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এর ফলে জ্বালানি তেল আমদানি কম করতে হবে। এতে কমবে ভর্তুকি। পাশাপাশি সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা।
ডলারের সঙ্কটে বিপিসির তেল আমদানিতে সমস্যা : চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় তেল আমদানিতে ঋণপত্র স্থাপন (এলসি খোলা) করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আবার জ্বালানি তেল আমদানির জন্য এলসি খুললেও সময়মতো এলসির দায় পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এ দিকে তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে অব্যাহতভাবে চাপ দেয়া হচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে চাহিদা অনুযায়ী এলসি খোলা সম্ভব না হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারেÑ এমন আশঙ্কা করছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন জায়গায় দফায় দফায় চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে সমাধান চেয়েছে বিপিসি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার জ্বালানি বিভাগে বিপিসি চিঠি পাঠিয়েছে।
এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দর এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় যথাসময়ে এলসি খোলা ও মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বিপিসি জানিয়েছে, এপ্রিল থেকেই ঋণপত্র খোলা ও তেলের দাম পরিশোধ নিয়ে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। মধ্যে কিছু ডলার ছাড়া হলেও এখন আবার নতুন করে ব্যাংকে সমস্যা হচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংক নতুন করে ঋণপত্র খুলতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। আবার ঋণপত্র খুললেও তেল সরবরাহকারীর দর পরিশোধে দেরি করছে কেউ কেউ।
ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ রাখা হবে : এক দিকে ডলার সঙ্কট অন্য দিকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারের ভর্তুকি ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য দেশে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে গতকাল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দেশে আমদানিকৃত ডিজেলের ১০ শতাংশ ব্যবহার হয় বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করে তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় এক হাজার মেগাওয়াট থেকে এক হাজার ১০০ মেগাওয়াট। জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে আজ সোমবার থেকে উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হবে। ফলে এক হাজার মেগাওয়াট থেকে এক হাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমবে। এতে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে বলে তিনি আশা করেন।
আজ থেকে ১ ঘণ্টা করে বিদ্যুতের লোডশেডিং : বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সঙ্কটের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নানা রকম সাশ্রয়ী নীতি গ্রহণ করেছে। কিছু কিছু দেশ দাম বৃদ্ধি করেছে। কেউ কেউ সাশ্রয়ী নীতি নিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশে যে পরিমাণ ডিজেল আমদানি হয়, তার ৯০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনবহির্ভূত খাতে ব্যবহার হয়। ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখার পর এখন যদি আমরা অন্যান্য খাতে ১০ ভাগ ভাগ বাঁচাতে পারি তা হলে আমাদের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। এ কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন এক হাজার থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি হতে পারে। এ ঘাটতি সমন্বয় করতে আজ থেকে পিকআওয়ারে এক ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হবে। এভাবে আমরা এক সপ্তাহ দেখব। এতেও ঘাটতি সমন্বয় না হলে আগামী সপ্তাহ থেকে আরো এক ঘণ্টা অর্থাৎ মোট ২ ঘণ্টা লোডশেডিং করা হবে। কখন, কোন এলাকায়, কতক্ষণ লোডশেডিং হবে, তা আমরা আগে থেকে জানিয়ে দেয় হবে বলে প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন।
মসজিদসহ উপাসনালয়ে এসি বন্ধ থাকবে : বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য মসজিদসহ সব উপাসনালয়ে নামাজ ও প্রার্থনার সময় বাদে বাকি সময়ে এসি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘শুধু মসজিদ নয়, উপাসনালয়ে (মসজিদ, মন্দির ও গির্জা) সবখানে প্রচুর এসি লাগানো হয়েছে। প্রার্থনার সময় বা নামাজের সময় বাদে বাকি সময়ে এসি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
পেট্রোল পাম্প সপ্তাহে এক দিন বন্ধ রাখা হতে পারে : জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য দেশের সব পেট্রোলপাম্প সপ্তাহে এক দিন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। এ জন্য পেট্রোবাংলাকে পেট্রোলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাথে বৈঠক করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এ ব্যাপারে সরকার চিন্তাভাবনা করছে। পেট্রোল পাম্পের মালিকদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
জ্বালানি সাশ্রয়ে আরো যেসব পদক্ষেপ : জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য আরো নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, যত্রতত্র সরকারি অফিসগুলোতে এসি না চালানো, সরকারি গাড়িতে জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমানো। এ ছাড়া অনলাইনে মিটিং করার সিদ্ধান্তের দিকে যাচ্ছে সরকার। একই সাথে অফিসের কর্মঘণ্টা কমানোর বিষয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত আসবে। এ ছাড়া একাধিক কর্মকর্তার জন্য পৃথক গাড়ি ব্যবহার না করে কয়েকজন মিলে একটি গাড়ি ব্যবহার করা যায় কি না তার সাম্ভব্যতা যাচাই করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকাল এ-সংক্রান্ত এক বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
মার্কেট ও শপিংমল খোলার নতুন সময় নির্ধারণ : এ দিকে ঢাকাসহ দেশের সব মার্কেট ও শপিংমল সকাল ৯টার পরিবর্তে বেলা ১১টা থেকে খোলা ও এসি ব্যবহার সীমিতকরণ বা পরিহারের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ দোকান ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের উদ্দেশে এ সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গতকাল সোমবার বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো: নাজমুল হাসান মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান টিপু স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারের বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার সিদ্ধান্তের সাথে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে একমত পোষণ করে ঢাকাসহ বাংলাদেশের সব মার্কেট, শপিংমল ও দোকান সকাল ৯টার পরিবর্তে বেলা ১১টায় খোলা এবং এসি ব্যবহার সীমিত বা পরিহার করার জন্য বিশেষভাবে আহ্বান করা যাচ্ছে।’
৯টা থেকে ৩টা পর্যন্ত অফিস করার প্রস্তাব : বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে অফিস সময় সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত করার প্রস্তাব এসেছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মো: ফরহাদ হোসেন। তবে এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি বলে জানান তিনি। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, অফিস সময় কমানো হতে পারে অথবা ওয়ার্ক ফ্রম হোম হবে। অফিসে যতটুকু না করলেই নয়, এমনভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করার বিষয়টি চিন্তা করছি। সপ্তাহখানেকের মধ্যে জানাব। মানুষের কষ্ট যাতে না হয়, সেটা বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত নেব। বিষয়টি আলোচনার পর্যায়ে আছে, কেউ বলছে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা বা ৪টা, তবে এটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর সাথেও আলোচনা চলছে। যেটা করলে ভালো হয় সেটাই করব। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সিদ্ধান্তটা আমরা নেব। আমরা সব বিষয় বিশ্লেষণ করে সঠিক কাজটি করার চেষ্টা করব।
ক্যাপাসিটি চার্জের কী হবে : এদিকে জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই প্রতি বছরই হাজার হাজার কোটি টাকা বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জের নামে দেয়া হচ্ছে তার কি হবে সে বিষয়ে জানতে চান খাতসংশ্লিষ্টরা।
এক পরিসংখ্যান মতে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৭টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বছরের অধিকাংশ সময় অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৩ হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বা বিপিডিবিকে; যা আগের বছরের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি। সম্প্রতি সরকারি তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটার্নাল ডেবট এ তথ্য জানায়।
দেশের এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে জানিয়ে এতে বলা হয়, ‘বসে বসে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে টাকা আদায় করা এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র অর্থনীতির গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া সরকার কোম্পানিগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে আসছে, যার ফলে বিদ্যুৎ খাতে বিশাল অর্থনৈতিক বোঝা বহন করতে হচ্ছে।’ সংস্থাটির পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ৬৫০০ মেগাওয়াট উৎপাদন-ক্ষমতাসম্পন্ন শীর্ষ ১২টি কোম্পানি আট হাজার কোটি টাকার বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ আদায় করেছে, যা ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রদত্ত মোট ক্যাপাসিটি চার্জের ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের সময় ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখা হবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জের নামে যে বাড়তি টাকা দেয়া হচ্ছে তা বন্ধ করে দিলে সরকারের ভর্তুকি আরো কমে যেত। সে বিষয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।