রবিবার, ০৪:৫৩ অপরাহ্ন, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ই-পেপার
নোটিশ :
মানব সেবায় নিয়োজিত অলাভজনক সেবা প্রদানকারী সংবাদ তথ্য প্রতিষ্ঠান।

এবার উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বন্যার অবনতির শঙ্কা

সময়ের কণ্ঠধ্বনি ডেস্ক:
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০২২
  • ৯১ বার পঠিত

সিলেট ও সুনামগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পানি নতুন করে না বাড়লেও বানভাসি মানুষের দুর্গতির কমতি নেই। সিলেট নগরীর নি¤œাঞ্চলের বাসাবাড়ি ও রাস্তাঘাট এখনো তলিয়ে রয়েছে। নেত্রকোনায় উজানের ঢলের পানি অব্যাহত থাকায় সেখানে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বিভিন্ন জেলার আশ্রয় কেন্দ্রসহ দুর্গম এলাকায় পানিবন্দী মানুষের খাদ্য, বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট বেড়েই চলেছে। ঘরবাড়ি আর ফসল হারানো মানুষের হাহাকারও বাড়ছে। এদিকে সংশ্লিষ্ট দফতর এবার দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বন্যার পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা জানিয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের ১১টি জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, হবিগঞ্জ ছাড়া সিলেট অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি আগামী ২৪ ঘণ্টায় স্থিতিশীল থাকতে পারে। অন্য দিকে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের নদীগুলোর পানি বাড়ছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, গতকাল সোমবার সকালে ৯টি নদ-নদীর পানি ১৯টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। ফলে ওই সময়ে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা, ধরলা ও দুধকুমারসহ সব প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। তবে ভারতের মেঘালয় প্রদেশে ভারী বর্ষণের প্রবণতা কমে এসেছে। তিনি বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। অন্য দিকে হবিগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে। তিনি বলেন, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এ সময়ে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অতিভারী বৃষ্টির আশঙ্কা আছে জানিয়ে আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, এর ফলে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার নদ-নদীগুলোর পানি সমতল দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।

কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ সোমবার সকালে বলেন, নাসার কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় হবিগঞ্জ জেলায় প্রায় ১৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ জেলার কোনো কোনো অংশে প্রায় ১২৫ মিলিমিটার পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের বৃষ্টির পানি যখন নেমে যাওয়া শুরু করেছে ঠিক সে সময় হবিগঞ্জে ৬ ঘণ্টা ধরে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত খুবই খারাপ সংবাদ। মৌলভীবাজারের মনু নদীর পানি হু-হু করে বাড়া শুরু করেছে সন্ধ্যা থেকে।

অন্য দিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড নদ-নদীর পরিস্থিতি ও পূর্বাভাস প্রতিবেদনে জানিয়েছে, সোমবার ৯টি নদীর পানি ১৯টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি নুনখাওয়া, হাতিয়া, চিলমারী ও ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি, কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ ও পোড়াবাড়ি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপরে উঠেছে যমুনা নদীর পানি। সুরমার পানি কানাইঘাট, সিলেট ও সুনামগঞ্জ পয়েন্টে, কুশিয়ারার পানি অমলশীদ ও শেওলায় বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। এছাড়া ধরলার পানি কুড়িগ্রাম, ঘাঘটের পানি গাইবান্ধা, খোয়াই নদীর পানি বাল্লা, পুরাতন সুরমার পানি দেরাই ও সোমেশ্বরীর পানি কমলাকান্দা পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

সিলেটবাসীর দুর্ভোগ দীর্ঘ হচ্ছে
সিলেট ব্যুরো জানায়, সুরমা নদীর পানি ধীরে ধীরে কমলেও সিলেটে বন্যার সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। প্লাবিত এলাকার বেশির ভাগ এখনো পানির নিচে রয়েছে। তলিয়ে আছে নগরের নিম্নাঞ্চলের বাসা-বাড়ি ও রাস্তাঘাট। ফলে বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষের দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এ দিকে কুশিয়ারার পানি সময় সময় বাড়ছে। সিলেট-বিয়ানীবাজার আঞ্চলিক সড়ক তলিয়ে গেছে। এই সড়কটির প্রায় ১০-১২ স্থানে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি। যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে যান চলাচল।

সিলেট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে জানান, সুরমা নদীর পানি কমলেও কুশিয়ারার পানি বাড়ার কারণে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার কিছু এলাকা নতুন করে প্লাবিত হতে পারে। এ ছাড়া গোয়াইনঘাট, কোম্পানিগঞ্জ, জৈন্তাপুর, সদর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ উপজেলা প্লাবিত এলাকার পানি ধীরে ধীরে কমছে বলে জানান তিনি।
এ দিকে সুরমা নদীর পানি কমতে থাকায় সিলেট নগরীতে প্লাবিত এলাকাগুলোর পানিও কমতে শুরু করেছে। তবে নগরের আবাসিক এলাকা শাহজালাল উপশহর, তালতলা, তেররতন, ঘাসিটুলাসহ বিভিন্ন এলাকা এখনো পানি রয়েছে। নগরীর বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হলেও প্লাবিত এলাকার মানুষ এখনো অন্ধকারে রয়েছেন। এসব এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় চরম সঙ্কটে রয়েছেন নগরবাসী।
এ দিকে পুরোপুরি নিরাপদ অবস্থানে ফিরল সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুৎকেন্দ্র। সোমবার বিকেলে কুমারগাঁওয়ে ব্রিফিংয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষে সিলেট জালালাবাদ সেনানিবাসের মেজর খন্দকার মো: মুক্তাদির ভয়াল বন্যায় পরিচালিত কর্মসূচির বর্ণনা দেন। ব্রিফিংয়ে সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বন্যার এই বিপদে যদি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেত তবে আমরা নগরবাসী আরেকটি মহাসঙ্কটের মধ্যে পড়ে যেতাম। জরুরি বিবেচনায় সিলেট সিটি করপোরেশন কুমারগাঁও কেন্দ্রটি সচল রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়।

অন্য দিকে রানওয়ে থেকে পানি নামলেও অ্যাপ্রোচ লাইট এখনো পানির নিচে তলিয়ে থাকায় সচল হচ্ছে না সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফ্লাইট চলাচল। আরো কয়েকদিন এই বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ থাকবে। এমনটি জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। সোমবার দুপুরে বিমানবন্দর পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
এ ছাড়া বিটিআরসি জানিয়েছে, মোবাইল অপারেটরদের প্রচেষ্টায় ৬৬০টি সাইট আবার সচল করা হয়েছে। বর্তমানে সব অপারেটরদের মোট এক হাজার ৭২টি সাইটে বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন হয়ে নেটওয়ার্কের আওতাবহির্ভূত রয়েছে। তবে ওই সাইটগুলো সচল করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

নেত্রকোনায় আরো অবনতি

নেত্রকোনা সংবাদদাতা জানান, অব্যাহত পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। আরো নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। প্লাবিত ১০ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা, সুসং দুর্গাপুর, হাওরাঞ্চলের খালিয়াজুরি ও মোহনগঞ্জ উপজেলা। জেলা প্রশাসন জানায়, ১০ উপজেলার ৬২টি ইউনিয়ন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। ২৬৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে এ পর্যন্ত ৫০ হাজারের অধিক নারী-পুরুষ আশ্রয় নিয়েছেন। সীমান্তের পাহাড়ি নদী মোমেনশ্বরী, কংশ, ধনু, গনেশ্বরী, উব্দাখালী, মঙ্গলশ্রী, মহাদেও ও মগড়া নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঢলের প্রবল স্রোতে অসংখ্য গাছপালা ও ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। মোহনগঞ্জ ইসলামপুর এলাকায় প্রবল পানির তোড়ে ভেঙে পড়া রেলব্রিজ মেরামত সম্ভব না হওয়ায় এখনো নেত্রকোনা-মোহনগঞ্জ রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থানের সড়ক ও রাস্তা ডুবে যাওয়ায় যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের দুর্গম এলাকার অসংখ্য নারী-পুরুষ পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরা পানিবন্দীদের উদ্ধার ও বন্যার্তদের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

কুলাউড়ার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী
কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) সংবাদদাতা জানান, কুলাউড়ার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। রোববার রাত ও সোমবার ভোর থেকে আবারো বৃষ্টিপাত হওয়ায় নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ করে কুলাউড়া পৌরসভার অধিকাংশ এলাকা এখন প্লাবিত। সরকারি হাসপাতাল, খাদ্য গুদাম, উপজেলা চত্বরসহ বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে পানি ওঠায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষ। বন্যাদুর্গতরা ত্রাণের অভাবে চরম অসহায় জীবনযাপন করছেন। এ দিকে উপজেলার হাওর অধ্যুষিত ভুকশিমইল, ভাটেরা, কাদিপুর, রাউৎগাঁও, বরমচাল, জয়চণ্ডী, ব্রাহ্মণবাজার এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এ দিকে উপজেলার প্রধান সড়কসহ শহরে যোগাযোগের বিভিন্ন এলাকার রাস্তাগুলো পানিতে তলিয়ে গিয়ে যাতায়াত ব্যবস্থা অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে। পৌর এলাকায় ৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। কুলাউড়ার ইউএনও এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, হাকালুকি হাওরে পানি বাড়ছে। এতে নিম্নাঞ্চলে পানি আসছে।

সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি বাড়ছেই
সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ হার্ডপয়েন্টে আরো ২১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৩৩ এবং কাজিপুরের মেঘাই ঘাট পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে টানা তিন সপ্তাহ দু’টি পয়েন্টেই পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার বন্যাকবলিত ছয়টি উপজেলার ৩২টি ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এতে বিশুদ্ধ পানির অভাবসহ বিভিন্ন সঙ্কট দেখা দিচ্ছে বানভাসিদের মাঝে। এ দিকে বাঁধ অভ্যন্তরের এ পরিস্থিতিকে বন্যা বলে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানালেও বন্যা মোকাবেলায় প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়।

কুড়িগ্রামে পানিবন্দী দেড় লক্ষাধিক
কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অন্তত দেড় লাখ মানুষ। এ অবস্থায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে দুর্গম চরাঞ্চলের বন্যাকবলিত মানুষজন। চুলা জ্বালাতে না পারায় এবং টিউবঅয়েল তলিয়ে থাকায় তীব্র হয়ে উঠছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অন্য দিকে একমাত্র আয়ের উৎস গবাদিপশুর খাদ্যসঙ্কট নিয়েও বিপাকে পড়েছেন চরাঞ্চলের মানুষ। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ার চরের শাহাজালাল জানান, এই চরের সব বাড়িঘরের অর্ধেকেরও বেশি তলিয়ে আছে। কিছু পরিবার অন্যত্র চলে গেলেও কিছু পরিবার নৌকায়, ঘরের ভেতর উঁচু করা মাচানে দিন-রাত পার করছে। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পানি কমার সম্ভাবনা রয়েছে।

তিস্তার পানি ৩১ সেন্টিমিটার উপরে
নীলফামারী সংবাদদাতা জানান, হু হু করে বাড়ছে তিস্তার পানি। সোমবার বেলা ৩টা থেকে তিস্তার পানি নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পাউবোর পানি পরিমাপক নূরুল ইসলাম জানান, সোমবার বেলা ১১টার পর থেকে বাড়তে থাকে তিস্তার পানি। দুপুর ১২টায় বিপদসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ও বেলা ৩টায় পানি বৃদ্ধি পেয়ে ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। এ দিকে তিস্তার পানি আকস্মিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে পাড়ের লোকজন। অনেকে অন্যত্র সরে যেতে শুরু করেছে। ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ১৫টি চর প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।

সুন্দরগঞ্জে ভাঙনের শিকার ২০০ পরিবার
সুুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) সংবাদদাতা জানান, ভাঙনে নদীতে ২০০ পরিবারের বসতবাড়িসহ বিলীন হয়েছে ফসলি জমি, রাস্তাঘাট ও বসতবাড়ি। ভাঙনের মুখে হাজারো একর ফসলি জমি ও শতাধিক বসতবাড়ি। এ ছাড়া পানিবন্দী হয়ে পড়েছে পাঁচ হাজার পরিবার। উপজেলার আটটি ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তার পানি বর্তমানে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে উপজেলার হরিপুর, শ্রীপুর চণ্ডিপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র আকারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের তথ্যমতে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২০০টি পরিবার এবং ৫০০ হেক্টর ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পানিবন্দীরা আশ্রয়কেন্দ্র এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে।

তিস্তা অববাহিকায় বন্যার অবনতি
রংপুর অফিস জানায়, গজলডোবার গেট খুলে দেয়ায় উজানের ঢল ও বর্ষণে তিস্তার পানি বিপদসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় তিস্তা অববাহিকায় বন্যার অবনতি শুরু হয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিস্তার পানি আরো বাড়বে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এরই মধ্যে দফায় দফায় পানির ধকলে ধুঁকছে মানুষ। নদীপাড়ের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, তিস্তায় পানি বৃদ্ধি শুরু হওয়ায় নীলফামারীর ডিমলার ছাতনাই এলাকা থেকে জলঢাকা, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম হাতীবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারী, সদর, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুরের ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত অববাহিকার ৩৫২ কিলোমিটার এলাকার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। রোববার দুপুরের নেমে যাওয়া বাড়িঘরে সোমবার সকাল থেকে আবারো কোথাও কোমর, কোথাও হাঁটুপানি।

সুনামগঞ্জে পুলিশের লাশ উদ্ধার
বাসস জানায়, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে বানের পানিতে তলিয়ে যাওয়া মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সদস্য আবুল কাশেমের (৩৮) লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গত রোববার রাত ১০টার দিকে তার লাশ পাওয়া যায়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দোয়ারাবাজার থানার ওসি। তিনি জানান, রাত ১০টায় উপজেলার আমবাড়ি বাজারস্থ একটি হাওরে কাশেমের লাশ পাওয়া যায়। নিহত কাশেম দোয়ারাবাজার উপজেলার টেংরাটিলা গ্রামের তাহের উদ্দিনের ছেলে। গত বৃহস্পতিবার দোয়ারাবাজার এক নিকটাত্মীয়ের জানাজা শেষে রাত ১০টায় তিনি মোটরসাইকেলে সিলেটে যাচ্ছিলেন। সুনামগঞ্জ-দোয়ারাবাজার রোডের মান্নারগাঁও রবি টাওয়ার এলাকায় বন্যার প্রবল স্রোতে মোটরসাইকেলসহ কাশেম তলিয়ে যান। তিন দিন ধরে তিনি নিখোঁজ ছিলেন।

ইসলামপুরে শিশুর মৃত্যু
ইসলামপুর (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, ইসলামপুরে বন্যার পানিতে ডুবে আরিফা (৭) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকাল ৬টার দিকে চিনাডুলী ইউনিয়নের ঘোনাপাড়া গ্রামের আলমের মেয়ে আরিফা মা-বাবার চোখের আড়ালে হঠাৎ বন্যার পানিতে ভেসে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থল থেকে আরিফার লাশ উদ্ধার করে। অন্য দিকে যমুনার বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বন্যার পানি ৪৮ বিপদসীমার সেন্টিমিটার দিয়ে ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা-ব্রহ্মপুত্রসহ জেলার সব ক’টি নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানি বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে দেখা দিয়েছে তীব্র নদীভাঙন। ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে উপজেলার গোয়ালেরচর ইউনিয়নের মুহাম্মদপুর গ্রামের অন্তত ১০টি বাড়ি বিলীন হয়েছে।

ছাতকের আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্যসঙ্কট
ছাতক (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, উপজেলার পৌর এলাকা ও ১৩টি ইউনিয়নের বন্যার পানি কিছুটা কমলেও দুর্ভোগ বাড়ছে বানভাসি মানুষের। এখনো নিমজ্জিত রয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্রে লাখো মানুষ চরম খাদ্যসঙ্কটে ভুগছেন। উপজেলা সদর, গোবিন্দগঞ্জ কলেজ ও মহাসড়ক সংলগ্ন আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়া অন্যান্য আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এখনো কোনো ত্রাণ ও রান্না করা খাবার পৌঁছেনি। খাদ্যসঙ্কটে চরম হাহাকার চলছে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে খাবার বিতরণ করা হচ্ছে, তবে তা চাহিদার চেয়ে অপ্রতুল। পাঁচ দিন বিদ্যুৎ না থাকায় বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। এ ছাড়া উপজেলার সর্বত্র ডাকাত আতঙ্ক রিরাজ করছে।

ডুবে গেছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর
চিলমারী (কুড়িগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তলিয়ে যাচ্ছে চিলমারীর একের পর এক এলাকা। তলিয়ে গেছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর। প্রায় এক সপ্তাহ পানিবন্দী থাকলেও সেখানকার বাসিন্দাদের মেলেনি কোনো সহায়তা। উপজেলার জোড়গাছ বাঁধ এলাকায় সম্প্রতি নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের একই স্থানে ১৫টি পরিবারের জন্য ১৫টি ঘর নির্মাণ করা হলেও আশ্রয়ণবাসীদের বের হওয়ার কোনো রাস্তার ব্যবস্থা না করায় বিপাকে রয়েছেন তারা। এ ছাড়াও উঁচু না করায় বন্যা আসতে না আসতেই তলিয়ে যাওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়েছে তারা। আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে রমনা মডেল ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম আশেক আকা বলেন, আমরা দ্রুত তাদের সহায়তার ব্যবস্থা করব।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2021 SomoyerKonthodhoni
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com