পদ্মা সেতু চালুর ফলে দক্ষিণের ২১ জেলার সঙ্গে যাতায়াত যতটা সহজ হওয়ার কথা ছিল, পরিবহন নেতাদের সিন্ডিকেটের কারণে তা হয়ে ওঠেনি। তাদের দাপটে খোদ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাসও চলতে পারেনি। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও অবশ্য দক্ষিণাঞ্চলের পরিবহন সংকট দূর করতে নতুন যানবাহন কেনার উদ্যোগ নিয়েছে বিআরটিসি। এরই মধ্যে ৩০০টি একতলা এসি বাস, ১০০টি কাভার্ড ভ্যান, ৪০০টি ওপেন ট্রাক, ১০টি মিল্কট্যাংকার ভ্যান, ১০টি রেফ্রিজারেটিং ভ্যান, ১০টি রেকার ও ৩০টি আধুনিক অ্যাম্বুলেন্স কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণাঞ্চলে কী কী রুট হবে, কোন মালিকের কয়টা গাড়ি চলবে, সেই হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে খুব বেশি গাড়ি নামেনি। এর প্রভাবে ভোগান্তিতে পড়েছেন ওই রুটের যাত্রীরা।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ঢাকা থেকে শরীয়তপুর, ফরিদপুর ও মাদারীপুরের বিভিন্ন উপজেলা পর্যন্ত বাস চলাচল শুরু হয়। কিন্তু সেতু চালুর এক মাসের মাথায় এসে এসব জেলার মানুষের কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর স্বপ্ন ভাঙতে শুরু করেছে।
এ বিষয়ে বিআরটিসির চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের পরিবহন চাহিদা বেড়ে গেছে। বিদ্যমান ব্যবস্থাপনা দিয়ে সেই চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। তাই যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে বিআরটিসির পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। তবে তার আগে মন্ত্রণালয় থেকে চাহিদার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল।
বিআরটিসির তথ্যমতে, ১৯৭২ সালে সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির বহরে নতুন গাড়ি সংযোজন শুরু হয়। পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ চাহিদা দ্বিগুণ হয়েছে। এতে করে দূরপাল্লার রুটে বিলাসবহুল বাসের চাহিদা বেড়েছে। বর্তমানে বিআরটিসির বহরে থাকা বাস চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এ জন্য নতুন একতলা এসি বাস কিনতে চাইছে সংস্থাটি। কেবল যাত্রী পরিবহন নয়, পণ্য পরিবহনেও ভূমিকা রাখতে চাইছে প্রতিষ্ঠানটি। কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়াতে স্বল্পসময়ে সাশ্রয়ীমূল্যে সার কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে চায় সরকার। এ জন্য বিআরটিসির ট্রাকের সংখ্যা বাড়ানো হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কৃষি, দুগ্ধজাত ও পচনশীল পণ্য মাছ, মাংস ও শাকসবজি ইত্যাদি পরিবহনে মিল্কট্যাংকার ও রেফ্রিজারেটিং ভ্যান সংযোজন করবে বিআরটিসি। এ ছাড়াও উৎপাদিত কৃষিপণ্য নির্ধারিত সময়ে জাহাজীকরণ ও বাজারজাত করতে বিআরটিসির ট্রাক থাকবে। শুধু কৃষিপণ্য পরিবহন নয়, শিল্পপণ্য পরিবহনে কাভার্ড ভ্যান ও ওপেন ট্রাক সংগ্রহ করতে চাইছে বিআরটিসি।
বর্তমানে বিআরটিসির ৮টি বিভাগে ২৪টি ইউনিট বা ডিপো রয়েছে। এর মধ্যে ২২টি বাস ও ২টি ট্রাক ডিপো। বিআরটিসির গাড়িগুলো অচল হয়ে পড়লে বা দুর্ঘটনাকবলিত হলে তা অপসারণের জন্য রেকার ভাড়া বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সংস্থাটি। প্রতিষ্ঠানটির দুইটি মেরামত কারখানা আছে। কারখানায় গাড়ি ও মালামাল স্থানান্তরের জন্য রেকারের দরকার। তাই ২০ টন ও ১০ টন ধারণক্ষমতার উদ্ধার যান কেনার প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। সরকারিভাবে অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা দেওয়ার কথাও ভাবছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি। হরতাল, অবরোধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাশ্রয়ীমূল্যে অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা দিতে ৩০টি অ্যাম্বুলেন্স কেনার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে। সব মিলে ৩০০টি একতলা এসি বাস, ১০০টি ১৬.২ টনের কাভার্ড ভ্যান, ৪০০টি ১৬.২ টনের ওপেন ট্রাক, মিল্কট্যাংকার ভ্যান ১০টি, রেফ্রিজারেটিং ভ্যান ১০টি, রেকার ১০টি ও ৩০টি আধুনিক অ্যাম্বুলেন্স কেনার প্রস্তাব দিয়েছে বিআরটিসি। দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কিছু প্রকল্প বাতিল হওয়াতে ভারতীয় ঋণে (এলওসি) বেশকিছু অর্থ অব্যবহৃত আছে কিনা, থাকলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিনা নিশ্চিত হতে চেয়েছে সংস্থাটি।
বর্তমানে বিআরটিসিতে ৩৬৯ জন স্থায়ী এবং ৩৭৫ জন অস্থায়ী কারিগর আছেন। এ ছাড়া কারিগরি কাজ তদারকিতে রয়েছেন ৪১ জন। সংস্থার অর্গানোগ্রামে চালকের অনুপাত হচ্ছে প্রতি গাড়ির জন্য ২ দশমিক ২৫ জন চালক। জরুরি ভিত্তিতে চালক নিয়োগেরও সুযোগ আছে। সংস্থার ৪টি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং ১৯টি ট্রেনিং সেন্টার আছে। বর্তমানে ১২৪৬টি সচল বাস বাস আছে। এ ছাড়া অকেজো ১০৩টি, দুর্ঘটনাকবলিত ২৫১টি বাস রয়েছে। সব মিলিয়ে আছে ১৬০০ বাস। ২০১১ সালে কেনা ২৭৫টি সিএনজি বাস, ২৫৫টি কোরিয়ান বাস এবং ২০১২ সালে ২৯০টি অশোক লেল্যান্ড দ্বিতল বাস, ৫০টি অশোক লেল্যান্ড আর্টিকুলেটেড বাস ও ৮৮টি অশোক লেল্যান্ড একতলা বাসসহ ৯৬৮টি বাস কেনা হয়। এসব বাসের মধ্যে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩২টি বাস অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়েছে। মারাত্মক দুর্ঘটনা বা অগ্নিসংযোগের মতো কারণে ২০৪টি বাস নির্ধারিত সময়ের আগে অকেজো হওয়ায় বিক্রি হয়েছে নিলামে। ২০২৫ সালের মধ্যে ৭৩২টি বাসের আয়ুষ্কাল শেষ হবে। অর্থাৎ সে হিসেবে এক হাজার ১৬টি বাস সংযোজন করার সুযোগ আছে। বর্তমানে বিআরটিসির সচল ট্রাক ৫০২টি। অচল আছে ৮৬টি। ইতোমধ্যে ৮৮টির নির্ধারিত আয়ুষ্কাল শেষ। এ ছাড়া বগুড়া ট্রাক ডিপো ও খুলনা ট্রাক ডিপোর কার্যক্রম আবার চালু হলে এবং দিনাজপুর ট্রাক ডিপো নতুনভাবে চালু হলে আরও ৬ শতাধিক ট্রাক বহরে যুক্ত করা সম্ভব। বিআরটিসির গাড়িবহর ঠিক রাখতে আয় বৃদ্ধি এবং যাত্রী সেবা সম্প্রসারণে এখনই নতুন গাড়ি সংগ্রহের উদ্যোগ নিতে বলেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া মেট্রোরেল ও বাস র্যাপিড ট্রানজিট চালু হলে কাক্সিক্ষত সেবা দিতে বিআরটিসির বাস দরকার। বর্তমানে ২০০ রুটে ১২৪৬টি বাস চলছে। এসব রুটে আরও ৯০২টি বাসের চাহিদা আছে। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের রুটে কমপক্ষে ২০০ বাস দরকার।
এদিকে বিআরটিসির জন্য দ্বিতল, একতলা এসি ও একতলা নন এসি বাস কেনা প্রকল্পের সমাপ্তি মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। সেখানে বলা হয়, ভারতীয় ঋণের আওতায় ৩০০টি দ্বিতল বাস, ১০০টি একতলা এসি ইন্টারসিটি বাস, ১০০টি সিটি বাস ও ১০০টি নন এসি বাস কেনা হয়। ২০১৯ সালের আগে এসব বাস সংগ্রহ করে বিআরটিসি। প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয় ২০১৬ সালে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বাসগুলো সচল অবস্থায় পাওয়া গেছে। তবে প্রকল্পের অধীনে যন্ত্রাংশ কেনা নিয়ে পর্যবেক্ষণ রয়েছে। দেখা গেছে, দ্বিতল বাসের যন্ত্রাংশ কেনায় ২৯৪টি আইটেমের মধ্যে ১৫টি লাইন আইটেম বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে কেনা হয়। এরপর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দুটি আইটেমের দাম কমিয়েছে। ১৩টি আইটেমের দাম বহাল রেখে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জানায়, বাজারের চেয়ে তাদের যন্ত্রাংশের মান ‘ভালো’। তাই দাম কমানোর সুযোগ নেই। একতলা এসি ইন্টারসিটি বাসের যন্ত্রাংশের ২৯৪টির মধ্যে ২৮৮টি সরবরাহ করেছে ঠিকাদার। বাকি ৪টি সরবরাহ না করায় মূল্য বাকি রেখে বিল পরিশোধ করা হয়েছে। একতলা এসি সিটি বাসের যন্ত্রাংশের ৪টির বিল বকেয়া রাখা হয়েছে। একতলা নন এসি বাসের জন্য ১৭০টি আইটেম কেনা হয়। ১টি আইটেমের যন্ত্রাংশ দিতে না পারায় সরবরাহকারীকে বিল কম দেওয়া হয়েছে। সংগ্রহ করা বাসের মধ্যে ঢাকা-যশোর রুটে ১টি ও চট্টগ্রাম-কোম্পানিগঞ্জ রুটে ১টি ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-কোম্পানিগঞ্জ রুটের বাসটি মেরামত হয়নি এখনো। আইএমইডি তাদের সুপারিশে বলেছে, প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত কোনো অডিট হয়নি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যেসব যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতে ব্যর্র্থ হয়েছে, সেগুলোর বিল বকেয়া রয়েছে। বিষয়টি নিয়মানুযায়ী হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখবে মন্ত্রণালয়। তা ছাড়া চট্টগ্রাম-কোম্পানিগঞ্জ রুটে পরিচালিত বাসটি দুর্ঘটনাকবলিত হয়েছে। এটি মেরামত করতে চলাচলের উপযোগী করতে সুপারিশ করেছে আইএমইডি।