দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে আবার অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকার পর মার্কিন ডলারের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। গতকাল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১২২ টাকা ৭৫ পয়সা দরে প্রতি ডলার বিক্রি করেছে, যা তিন কার্যদিবস আগেও ছিল ১২২ থেকে ১২২ টাকা ৩০ পয়সার মধ্যে। হঠাৎ ডলারের দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের অভিযোগ, ব্যাংকগুলো বেশি মুনাফা করতে ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাঁরা। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে ব্যাংকাররা বলেছেনÑ কোনো বাড়তি মুনাফা নয়, বাজারভিত্তিক নীতির মাধ্যমেই ডলার কেনাবেচা করছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মো. শাহরিয়ার সিদ্দিকী আমাদের সময়কে বলেন, সরকারি কিছু পেমেন্টের কারণে ডলারের চাহিদা বাড়ায় দাম কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। শিগগিরই ডলারের দাম স্থিতিশীল হবে। ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে বাড়তি মুনাফা করার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসেনি। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এলে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আইএমএফের ঋণচুক্তির শর্তপূরণের অংশ হিসেবে গত মে মাসে ডলারের বাজারভিত্তিক বিনিময়হার পদ্ধতি চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর থেকে ব্যাংকগুলো চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে ডলারের দাম নির্ধারণ করছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের দাম বৃদ্ধির পেছনে প্রধান কারণ হলো আমদানি ঋণপত্র বা এলসি খোলার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া। দীর্ঘ সময় ধরে ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে যে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল, তা কিছুটা শিথিল হওয়ায় এবং প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও নিত্যপণ্যের আমদানি বাড়ায় বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকও বাজার থেকে ডলার কেনা অব্যাহত রেখেছে। এতে দাম কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী। তবে আমদানিকারকরা অভিযোগ করছেন, বাজারে বড় ধরনের চাপ না থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ডলারের দাম বাড়াচ্ছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছেন তাঁরা।
চট্টগ্রামভিত্তিক শীর্ষ একটি ব্যবসায়িক গ্রুপের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমানে ডলার বৃদ্ধির পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। আমাদের মনে হচ্ছে ব্যাংকগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ডলারের দাম বাড়াচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, বছরের শেষ প্রান্তিক এলেই ব্যাংকগুলো দাম বাড়ানো শুরু করে, যাতে বছর শেষে অতিরিক্ত মুনাফা করতে পারে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আমদানিকারকরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় ডলারের দামে এখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করার অনুরোধ জানান তিনি।
একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, একাধিক কারণে ডলারের বেড়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন অপেক্ষাকৃত বেশি দামে ডলার কিনছে। দ্বিতীয়ত, আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ বাড়ছে, যা বাজারে ডলারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তৃতীয়ত, রেমিট্যন্স সংগ্রহে ডলারের দাম বেশি পড়ছে।
বিভিন্ন ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গতকাল বেসরকারি খাতের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে প্রতি ডলারের বিক্রয়মূল্য ছিল সর্বোচ্চ ১২২ টাকা ৭৫ পয়সা এবং তারা ডলার ক্রয় করেছে ১২১ টাকা ৭৫ পয়সা দরে। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে ডলারের বিক্রয়মূল্য ছিল ১২২ টাকা ৬০ পয়সা এবং ক্রয়মূল্য ছিল ১২১ টাকা ৬০ পয়সা। বেসরকারি খাতের ঢাকা ব্যাংক প্রতি ডলার বিক্রি করেছে ১২২ টাকা ৫০ পয়সায় এবং ক্রয় করেছে ১২১ টাকা ১৫ পয়সায়। গত সপ্তাহের তুলনায় প্রতিটি ব্যাংকেই ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আমদানি ব্যয়কে সরাসরি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ডলারের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা আন্তঃব্যাংক বিনিময় হারকেও প্রভাবিত করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গতকাল আন্তঃব্যাংক বাজারে ডলারের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১২২ টাকা ২৫ পয়সা, যা মঙ্গলবার ছিল ১২২ টাকা। অর্থাৎ, মাত্র এক দিনের ব্যবধানে এখানেও ডলারের দাম ২৫ পয়সা বেড়েছে। আন্তঃব্যাংক বাজারের ডলারের দামের এই বৃদ্ধিকে মুদ্রা বাজারের অস্থিরতার ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আমাদের সময়কে বলেন, এই মুহূর্তে ডলারের বাজারে যে ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে, তা বাস্তব পরিস্থিতির প্রতিফলন নয়। এতে ব্যবসায়ীরা শুধু নয়, সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়বে। কারণ, ডলারের কারণে আমদানি ব্যয় বাড়লে উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে পণ্যমূল্য বেড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। তাই আমি মনে করি ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকা উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে ২.১২ বিলিয়ন ডলার কিনেছে। এর মধ্যে গত সপ্তাহেই ছয়টি ব্যাংক থেকে ৩৮ মিলিয়ন ডলার কেনা হয়েছে। এসব ডলার কেনার ক্রয়মূল্য ছিল ১২১ টাকা ৮০ পয়সা। অন্যদিকে, গত সেপ্টেম্বরে আমদানি এলসি খোলার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬.৩ বিলিয়ন ডলার, যা আগস্টে ছিল ৫.৩৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, এক মাসের ব্যবধানে এলসি খোলার প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। এতে বিদেশি মুদ্রার চাহিদা বাড়ায় বিনিময় হারেও প্রভাব পড়েছে।