গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর দলের একটি অংশের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে সমালোচনার মুখে পড়ে বিএনপি। এসব নেতাকর্মীকে সঠিক পথে আনতে গত কয়েক মাস নানা উদ্যোগ নেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার নির্দেশে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজের সঙ্গে যুক্ত প্রায় দুই হাজারের মতো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। এই অবস্থায় যুক্তরাজ্যে চিকিৎসা শেষে চার মাস পর গত মঙ্গলবার দুই পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান ও সৈয়দা শামীলা রহমানকে সঙ্গে নিয়ে দেশে ফিরেন দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
পথে পথে খালেদা জিয়াকে বরণ করতে সড়কে দলীয় নেতাকর্মীসহ জনতার ঢল নামে। এই জনসমুদ্রকে সুশৃঙ্খলায় রাখতে দলীয় নেতাকর্মীদের বিশেষ নির্দেশনা দেন তারেক রহমান। সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি দলীয় শৃঙ্খলায় নিয়োজিত টিম তার নির্দেশনা অনুযায়ী বেশ তৎপরতা চালায়।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া- সার্বিকভাবে এটা বিএনপির জন্য বিশাল বিজয়। এটা বড় পরীক্ষাও ছিল দলের জন্য। কারণ, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান খুব দ্রুত দেশে ফিরবেন। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি যখন দেশে ফিরবেন, তখন রাজধানী জনতার মহাসমুদ্রে পরিণত হবে। তখন সেই জনমহাসমুদ্রের শৃঙ্খলা কীভাবে রক্ষা করা হবে- এবারের জনসমুদ্র বিএনপির জন্য বড় বার্তা। এখানে যদি ব্যর্থ হতো দল, তাহলে তারেক রহমানের নেতৃত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ত। সেই পরীক্ষায় তিনি শতভাগ পাস করেছেন। আগামীতে তিনি দেশ পরিচালনায় যে সফল হবেন, এটা এখান থেকেই ধরে নেওয়া যায় বলে মনে করেন নেতারা।
জানতে চাইলে বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^র চন্দ্র রায় আমাদের সময়কে বলেন, ‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরায় নেতাকর্মীসহ দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ উজ্জীবিত। যিনি সড়কে ছিলেন না, তিনিও ঘরে বসে বা যে যেখানে ছিল সেখান থেকে প্রিয় নেত্রীর খোঁজ নিয়েছেন। তাকে সড়কে সুশৃঙ্খলভাবে যেভাবে দেশের মানুষ ভালোবাসা দিয়ে সিক্ত করেছেন এটা বিএনপির জন্য বড় প্রাপ্তি।’
গতকাল বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক বিবৃতিতে জানান, দেশনেত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে আসা সাধারণ মানুষ এবং দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ ছাড়াও ওই সময় সামরিক (সেনা, নৌ ও বিমান) বাহিনীর সদস্যবৃন্দ, পুলিশ, র্যাব ও এভিয়েশন সিকিউরিটির (অঠঝঊঈ) সদস্য যারা নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের প্রতিও আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে।
এদিকে খালেদা জিয়ার এবারের দেশে ফেরা ভিন্ন রকমের। তিনি দেশে ফেরার পর সামগ্রিকভাবে রাজনীতির চিত্র বদলে যেতে পারে। আমাদের রাজনীতির আকাশে মাঝেমধ্যে অনিশ্চয়তার মেঘ এসে হানা দেয়। এখনও নানা ধরনের অনিশ্চয়তা আছে। খালেদা জিয়ার পরামর্শ ও অভিজ্ঞতার আলোকে সেই মেঘ কেটে যাবে বলেই মনে করা হচ্ছে। সেই মেঘ যতদূর কাটবে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথও তত সহজ হবে, যা তারেক রহমানের দেশে ফেরা আরও সহজ করবে বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে যেসব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তাদের মধ্যে সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। তা দূর করার ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া একটা ভূমিকা রাখতে পারবেন। কারণ এখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের এক ধরনের অভিভাবকত্ব পেয়েছেন, তার ওপর সবার আস্থা রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, গণতন্ত্রে উত্তরণের এই সময়ে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি একটি উল্লেখযোগ্য দিক। তার ফিরে আসা আমাদের গণতন্ত্র উত্তরণের পথকে আরও সহজ করবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম মনে করেন, বাংলাদেশে বেশ কয়েকবার গণতন্ত্র ফিরেছে খালেদা জিয়ার হাত ধরে। গণতন্ত্রকে সরকারিভাবে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে উনার হাতেই। নব্বইয়ের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধেও লড়াই করেছেন, গত ১৫ বছর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধেও লড়াই করেছেন। ওইখানে এক দশক, এখানে ১৫ বছর- দুই যুগ লড়াই করেছেন গণতন্ত্রের জন্য। আবার তিনি তিনবার ক্ষমতায় থেকেও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য লড়াই করেছেন। এজন্যই বলছি, তিনি বারবার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই এখন জনগণের কাছে একটা আইকন, একটা ভরসার জায়গায় চলে গেছেন।
এদিকে ভালোবাসা ও বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের মধ্যে খালেদা জিয়ার ফিরে আসা বিএনপির নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে তুলেছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বেশ খুশিও বলে জানান দলীয় নেতারা। দলীয় সূত্রে জানা যায়, উন্নত চিকিৎসা ও পারিবারিক আবহে গত চার মাসে বেগম খালেদা জিয়া মানসিক ও শারীরিকভাবে অনেকটাই সুস্থ। যার প্রমাণ মেলে তিনি গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে বাসায় প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে।
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, আরও কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের তিনি সাক্ষাৎ দেবেন। আপাতত গুলশানের ভাড়া বাসায় এই ব্যবস্থা চালু করা হতে পারে। দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থান এখন বিএনপির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তিনি এখন গণতন্ত্রের প্রতীক।